পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

এবারের ভোট কথায় কোনও রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীকে নিয়ে কথা বলব না, কথা বলব রাজনীতির সাইড এফেক্ট নিয়ে। রাজ্য রাজনীতিতে তখন বহু আলোচিত নাম নানুর। বীরভূমের নানুরে চণ্ডীদাসের ভিটে। রামী ধোপানীর সঙ্গে চণ্ডীদাসের প্রেমের সাক্ষ্য দেবে এখনও সেই পুকুর ঘাট, যেখানে কাপড় কাচত রামী। কিন্তু সে কারনে নয়, নানুরের খ্যাতি বা কুখ্যাতি ছড়িয়েছিল অন্য কারনে। ঘরে ঘরে বোম বাঁধার কুটির শিল্প, কারনে অকারনে তার মুড়ি মুড়কির মত ব্যবহার। ধারাবাহিক হিংসা বাম আমলে নানুরকে এক আলাদা পরিচিতি দিয়েছিল। সূচপুরে গণহত্যা সেই পরিচিতির রক্তিমতাকে আরও গাঢ় করে। প্রতিদিন খবরের শিরোনামে তখন নানুর এবং আশপাশের গ্রামের নাম। নানুর এমনিতেই উত্তপ্ত বছরভর, সেখানে ভোট এলে তো কথাই নেই। বোমা শিল্পীদের ব্যস্ততা এবং চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। লোকসভা ভোটের বেশ কয়েক মাস আগে থাকতেই আমরা নজর রাখছিলাম নানুরের উপরে। আমার নানুরে সেই সময়ের সহকর্মী পরিতোষ দাস। গোপনে বলা ছিল পরিতোষকে, বোমা বাঁধার একটা ভাল ছবি করতে হবে। পরিতোষ বলেছিল, দাদা আপনাকে আসতে হবে, স্থানীয় মানুষকে ওরা পুরোপুরি বিশ্বাস করবে না। বললাম ঠিক আছে নজর রাখ। 

পরিতোষ স্থানীয় ছেলে, তখন দাশকলগ্রামে ও থাকত। কাজের ছেলেও বটে। তক্কে তক্কে থেকে ঠিক কয়েকজনের হদিশ বার করল। অতি কষ্টে তাদের একজনের নম্বর মিলল। এবার আমার পালা। প্রায় একমাস ধরে ওই নম্বরে ফোন করে পটানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তখন তো টিভি ক্যামেরা এতো জলভাত হয়ে যায়নি। তখন সাংবাদিককে কিছুটা ভয় ভক্তি করত লোকে, ফলে তারা তো ভয়ে আর মানতেই চায় না। মাস খানেকের চেষ্টার পর রাজি হল দুজন, শর্ত মুখ দেখানো চলবে না। তাদেরকেই বললাম গোপন ডেরায় গিয়ে ছবি তুলব কিন্তু। ডিটেলে সব নেব। পাঁচ ছজন থাকলেই হবে বেশি লোক চাই না। শেষমেশ কথা হল আমি আর পরিতোষ এই দুজনই যেতে পারব, এবং কোনও রকম বেচাল দেখলে তারা আমাদের জীবনের দায়িত্ব নেবে না। 

এবারে এল সেই দিন। আমি কীর্ণাহার পৌঁছে গাড়ি সেখানেই রেখে দিলাম। বাইক নিয়ে যেতে হবে আমাদের। পরিতোষের বাইকের পিছনে চেপে আমরা চলেছি ওদের বলে দেওয়া একটি নির্দিষ্ট জায়গায়। সেখানে পৌঁছিয়ে সামান্য দাঁড়াতেই হাজির আর একটি বাইক। সেই বাইককে অনুসরণ করলাম আমরা। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর থামল বাইক। এবার হেঁটে যেতে হবে। আশপাশে ধু ধু মাঠ। কেউ কোত্থাও নেই, সামনেই একটা বাঁশবন। একজন এসে আগাপাশতলা দেখে নিল পরীক্ষা করে। চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল কেউ সাথে নেই তো? না বললাম বটে, কিন্তু একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল যেন। ঠান্ডা গলায় বলল, সামনে বনের পথ ধরে এগিয়ে যান। এগোলাম, বাঁশ গাছের ফাঁক গলে খানিকটা যাওয়ার পর দেখা মিলল ওদের। প্রথম প্রথম দু পক্ষেরই একটু জড়তা, অস্বস্তি, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলতা। সেটা কেটে যেতেই জমে উঠল কথাবার্তা। অনেক কথা হল, ওদের দুঃখ সুখ, চাওয়া পাওয়া, ব্যথা আনন্দ নানা বিষয়। খুব সুন্দর করে যত্ন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরি শেখাল ওরা। শেখাল বন্দুক ধরা, তাতে গুলি ভরাও। প্রথম প্রথম একটু ভয় থাকলেও পরে আমিও অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছিলাম ওদের সঙ্গে। 

ওদের কথা শুনতে শুনতে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম সামান্য কটা টাকার জন্য কিভাবে নিজেদের জীবনকে বাজি রেখেছে ওরা। সব রাজনৈতিক দলের হয়েই ওদের কাজ। অথচ কাজ ফুরালে কেউই দেখে না ওদের। এ কাজের পরিণতি মৃত্যু জেনেও নির্বিকারে বোমায় সুতলি জড়ায় ওরা। মনটা ভার হয়ে গিয়েছিল। আমায় কিন্তু কোনও অসম্মান করেনি ওরা, দাদা দাদা করে বরং বেশিই সম্মান দেখিয়েছিল। ফেরার পথ নেই, তাই মুখ ঢেকেই ভালবাসা জানিয়েছে, ভোটের আগে ব্যস্ততা থাকা সত্বেও প্রায় সকলেই ঘন্টাখানেক ধরে আমার সঙ্গে কথা বলেছে, আমাদের চাহিদা মত ছবি তুলতে দিয়েছে। ফিরে আসার সময় যুদ্ধ জেতার আনন্দ থাকলেও একটা রক্তক্ষরণ ছিল ভিতরে। ভোটের সময় ক্ষমতা পাওয়ার লড়াই, ভোটের পরে ক্ষমতা রাখা বা ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই। তাই এই শিল্পের সাইড এফেক্ট হিসেবে ভোটের উপস্থিতি এবং বিস্তার উপেক্ষা করা যায় না।

এই খবরের একটা ভিডিও ছিল, যেটা খবরাকারে ইটিভিতে দেখানো হয়। যেহেতু আগে সেই খবরটি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছিল তাই অনেকেই দেখে থাকতে পারেন। প্রাসঙ্গিক বলে আমি এখানে আরও একবার দিয়ে দিচ্ছি। পরে এই ধরনের খবর অন্য চ্যানেলে আমিও বহুবার দেখেছি। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে এধরনের খবর এত বিশদে বাংলা সংবাদ মাধ্যমে সেভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়নি। তাই বীরভূম জেলা তথা রাজ্য রাজনীতিতে এই খবরটি বেশ আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। আমার কাছে ফোন এসেছিল ভবানী ভবন থেকেও। কোথায় এই খবর শ্যুট করেছি তা বলতে হবে। সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা এবং সৌজন্য মেনে সেটা পুলিশ কর্তাদের বলতে পারিনি। তবে বললেও কিছুই হত বলে মনে হয় না, প্রথমত পুলিশের জায়গা অজানা হলেও বিষয়টা মোটেই অজানা নয়। দ্বিতীয়ত, ওরা এক জায়গাতে দিনের পর দিন থাকে না। পুলিশও বুঝেছিল, তাই পরে আর জোর করেনি। ভোটের সন্ত্রাসে এখনও বীরভূমের নাম দেখলেই মনে পড়ে যায় সেই মুখবাঁধা মুখগুলির কথা। মনে পড়ে সেই হাহাকার, “নিশ্চিৎ মৃত্যু জেনেও এ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি দাদা। ফেরার পথ নেই।” (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Nanur bomb)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours