সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:
গতকাল তখন কলকাতার ব্রিগেডে ভাষণ দিচ্ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। সাংবাদিকতার এক পেশাগত তাগিদে মন দিয়ে ভাষণটা শুনছিলাম। আচমকা ছন্দপতন। টুং শব্দ করে মোবাইলে একটা নোটিফিকেশন ভেসে উঠল। দ্য অফনিউজ'এর জন্য হোয়াটসঅ্যাপে লেখা পাঠিয়েছেন শিলিগুড়ি থেকে সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখার বিষয়বস্তু 'নারী দিবস'।
কান দিয়ে শুনে গেলেও আক্ষরিক অর্থে ভাষণ উঠল মাথায়। মনটা সেই থেকে খচখচ করছে। নারী দিবস নিয়ে একটা লেখা লিখলে মন্দ হতো না। কিন্তু এবারের নারী দিবসে কাকে নিয়ে যে লিখি সেটা ভেবেই কাবাড় একটা গোটা দিন। মেয়েকে নিয়ে লিখলে কেমন হয়? মন বলল, ওরে কৌশিকীকে নিয়ে তো কম লিখিসনি। তবে, প্রাক্তন প্রেয়সীকে স্মরণ করে তো কিছু একটা লিখতে পারিস। মন সায় দিল না। উল্টে বলল, তুই তো হরদম ওকে নিয়ে লিখেই চলেছিস। তাহলে সোকলড কোনও অতি বিখ্যাত মহিলাকে নিয়ে একটা লেখা লিখলে বেশ হয় তাই না? দূর! আরে বাবা উনারাতো বহুল চর্চিত তোর লেখনীর আগেই।
নারী দিবসের সকালেই শয্যা না ছাড়া বিছানায় মনে পড়ে গেল হঠাৎ একটা মুখ। ঠিক তো। এই তো সেই নারী। এবছরের নারী দিবসে আমার কামনার একান্ত মুখ যে তিনিই। কলকাতার আদ্যন্ত বাসিন্দা। ক্যালেন্ডার ওল্টালে ঠিক এক বছর আগে আমি তাঁকে প্রথম দেখি গতকালের মোদীর ব্রিগেডের অনতিদূরে। সখেরবাজারে। কোনও এক সকালে। ষাট ছুঁই ছুঁই বছরের এক সৌম্যদর্শনা নারী বসে আছেন আমার সামনের চেয়ারে। অতি সাধারণ অনাদর গেরুয়া বসনে শরীর আবৃত। চুলে যে পরিপাটি চিরুনি লাগেনি তা স্পষ্ট বোঝা যায়। অথচ চোখের চাহনির ভাষায় কি শীতল পরিপাটি সদাস্নেহের মুক্তধারা। মুখের হাসি যেন বলতে চায়, আমিতো আছি, আপনাদের কিসের চিন্তা। আমার কাছে যে সবাই আশ্রয় পায়। বিশ্বাস করুন সেদিনের এমন দৃষ্টি, এমন হাসি আমি আজও এড়াতে পারিনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি, ঈশ্বর প্রকৃতই মানবদরদী হয় শুনেছি, কিন্তু এই অতি সাধারণ নারীও যে এমন প্রচারবিমুখ মানবসেবী হতে পারেন তা আমার কল্পনার অতীত।
নাম গার্গী গুপ্ত। বিশ্বখ্যাত ঠাকুরপুকুর ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার ও হাসপাতালের প্রানপুরুষ প্রয়াত চিকিৎসক সরোজ গুপ্তের ভাইজি গার্গীদেবীর আরও একটা নিজস্ব পরিচয় আছে। তিনি আট থেকে আশি সবার 'দিদিভাই'। উনি আমার মেয়েরও দিদিভাই আমারও দিদিভাই। পূর্ব রেলের কলকাতার অফিসে কাজ করতেন। পরে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে মানুষের সেবার কাজেই নিজেকে নিযুক্ত করেছেন সর্বক্ষণ। আজ থেকে ঠিক ত্রিশ বছর আগে জনা পাঁচ ছয়জন অন্ধ ছেলেমেয়েকে আপন করে নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন এক অচেনা পথে। সেই অচেনা পথের নাম আজকের 'ভয়েস অফ ওয়ার্ল্ড'। বর্তমানে দিদিভাইয়ের পরম প্রশ্রয়ে প্রায় তিনশো মানুষের একমাত্র ঠিকানা হল এই ভয়েস অফ ওয়ার্ল্ডের নানা শাখা প্রশাখা।
ভয়েস অফ ওয়ার্ল্ডের অন্দরমহলে ঢুকলেই দেখা মিলবে কেউ দৃষ্টিহীন। কেউ বা শারীরিক পর্যায়ে স্বাভাবিক নয়। অনেকেই রয়েছে মানসিক অবসাদের শিকারগ্রস্থ হয়ে। তবে কিছু সুস্থ মানুষের আনাগোনা সেখানে চোখে পড়ে। আসলে পূর্ণ সুস্থরাও সেখানে যে একেকজন নিজ নিজ ক্ষেত্রে মসিহা এহেন সেবাযজ্ঞের। দিদিভাইয়ের একটাই বক্তব্য, ঈশ্বরের আশীর্বাদে এখানে প্রতিদিন তিনশো মানুষের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় বিনামূল্যে। এখানে সবাই নিরাপদে থাকে প্রত্যেকে যে যার কাজের মধ্যে দিয়ে মাথা উঁচু করে। তাই ভয়েস অফ ওয়ার্ল্ডে কারো হীনমন্যতার স্থান নেই। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন এসে যায়, একজন জন্মান্ধ বা শারীরিক প্রতিবন্ধী এখানে কিবা আর কাজ করবে। দিদিভাইয়ের তৎক্ষণাৎ জবাব, কেন? যে প্রতিবন্ধী সে অন্ধের সহায়তায় স্থানান্তর করবে। আর যে অন্ধ সে দুনিয়া দেখবে প্রতিবন্ধীর সহচর্যে। এটাও তো একটা কাজ। এটাও একটা সেবা। আমি এই পরস্পরের পরিপূরকের একটা আস্ত সমাজ গড়ে তুলতে চাই ভয়েস অফ ওয়ার্ল্ডে যেখানে যে যার নিজের নিজের কাজে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাববে, জানালেন দিদিভাই।
কলকাতায় কলেজে পড়ার সূত্রে আমার মেয়ের সঙ্গে দিদিভাইয়ের সংযোগ। তারপর থেকেই কৌশিকীর একটা নিজস্ব পছন্দের জগৎ হয়ে ওঠে এই ভয়েস অফ ওয়ার্ল্ড। এটাই যেন মেয়ের মনে ধরা একটা পরিপূর্ণ পরিবার। এখানেই যেন তার সমস্ত আত্মীয়তার নিবিড় শিকড়-প্রবেশ। আর দিদিভাই যেন আজ তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। এই আত্মিক সম্পর্কের মায়ার কাছে আমার পিতৃত্বও কখনও যে হার মেনে নেয়।
এইতো গত মাসের কথা। একটা সামাজিক কাজকে কেন্দ্র করে দিদিভাই একদল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে সটান পুরুলিয়া হাজির। মেয়েও ছিল সেই দলে। আমিও দুর্গাপুর থেকে সেখানে যাই। যা হয় আর কি। মেয়েকে দেখেই পড়াশোনা নিয়ে চেপে ধরা পুরুলিয়ার লাল মাটিতেই। দুই এক কথায় আমিও শুরু করি বকাঝকা। ওমা, দেখি মেয়ে আমার হনহন করে হেঁটে গিয়ে অদূরে খাটে বসে থাকা দিদিভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। তখনই বুঝলাম আমার মেয়ে কি পরম মাতৃ আশ্রয়েই না এখানে রয়েছে। যা আমার পিতৃত্ব থেকেও কখনও বড় হয়ে যায় অনায়াসেই। সেই মানবিক উপবনে, যেখানে এক যুবতী মেয়ে বাবার বকুনি খেয়ে পরক্ষণেই এক নিশ্চিন্তের মানবিক আশ্রয় খুঁজে ফেরে। মাস ছয়েক আগে একদিন মেয়ে আমায় বলেছিল, জানো বাবা আমাকে না আজ দিদিভাই খাইয়ে দিয়েছে। দিদিভাইকেও আমরা সবাই খাইয়ে দিই। এই ছোট্ট উপমাগুলো ভাবলে একেক সময় মনে হয়, দিদিভাই যেন 'সম্পর্ক' বাংলা শব্দটার একটা গোটা অভিধান। যে সম্পর্ক মানবিকতার। যে সম্পর্ক নিঃস্বার্থ সেবার। যে সম্পর্ক পূর্ণ আত্মত্যাগের।
তবে এই চির অবিবাহিতা সর্বত্যাগী নারীকে আমাদের দেশ কিন্তু চিনতে ভুল করেনি। ২০১৭ সালে তাই রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ দিদিভাইয়ের হাতে তুলে দেন নারীশক্তির রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। নারী দিবসে এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির স্মৃতিচারণা আজ যেন সত্যি আমার কাছে বড্ড বেশিরকম সবুজালি হয়ে উঠেছে।
এখানেও আবার প্রশ্ন উঠতেই পারে আজকের নারী দিবসে শুধু দিদিভাই কেন? উত্তর খুঁজতে হলে দিন চার আগের একটি ঘটনায় হামাগুড়ি দিতে হয়। সেদিন দিদিভাই কয়েকজনের সঙ্গে আমাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন ঋষি অরবিন্দের কোনও একটি শাখা আশ্রমে। ঢুকেই দেখি একটা প্রার্থনা বেদী। তাতে লেখা আছে, হে ঈশ্বর তুমি আমাকে সহ্য করো। এই লাইনটা পড়ে এক অদ্ভুত অজানা আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে যাই ক্ষণিকের জন্য। মনে আমার একটাই কথা উঁকি মারছে সেই থেকে, হে নিরাকার ঈশ্বর তোমাকে আমি আজও দেখিনি। দেখেছি দেবতারূপী দিদিভাইকে। তাই দিদিভাইকেই আমার উল্টে জিজ্ঞাস্য, আমার মতো অধমকে আপনি সহ্য করেন কেন?
আজও যে দিদিভাই আমাকে সহ্য করে চলেছেন। তাই তিনি যে আজকের নারী দিবসে আমার জানা শ্রেষ্ঠ নারী। আমার দিদিভাই। এক মানবতার বাস্তব নিঃস্ব ফেরিওয়ালা।
(www.theoffnews.com - international women's day Gargi Gupta)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours