সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, শিলিগুড়ি:

একবিংশ শতাব্দীর অত্যাধুনিক ডিজিটাল দুনিয়ায় ঘরে বাইরে কেমন আছে মেয়েরা? 

৮ই মার্চ। দিনটি যে আন্তর্জাতিক নারীদিবস!

প্রতিবছর সাড়ম্বরে সভা-সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অথবা জ্বালাময়ী বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ দিনটি। নেপথ্যে রয়ে যায় রক্তে ভেজা ইতিহাস। 

‘নারী!' সমাজের দূর্বল অবহেলিত অর্ধাংশ।  ‘মানুষের’ আগে তাদের পরিচিতি ‘মেয়েমানুষ’! নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে, উন্নয়নশীল প্রাচ্য থেকে উন্নত পাশ্চাত্য, ধনী থেকে দরিদ্র, শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত এমনকি ধর্মীয় বিভেদ মুছে গিয়ে এক আশ্চর্য বৈষম্যহীনতা। সীতা, সাবিনা বা মারিয়া সবাই এক সারিতে।

'দ্য স্টেট অফ ওয়াল্ড পপুলেশন -২০২০’এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭০ থেকে ২০২০ বিগত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বে প্রায় ১৪ কোটি ২৬ লক্ষ নারী পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। এরমধ্যে ভারতীয় নারীর সংখ্যা ৪ কোটি ৫৮ লক্ষ। ২০১৩ থেকে ২০১৭ মাত্র চার বছরে ৪ লক্ষ ৬০ হাজার শিশুকন্যা জন্মের পরেই নিখোঁজ। এরমধ্যে গর্ভকালীন অবস্থায় কন্যাভ্রূণ হত্যা হয় দুই তৃতীয়াংশ জন্মের পর তীব্র অবহেলিত হয়ে মারা যায় বাকী এক তৃতীয়াংশ। বিশ্বে ১২ থেকে ১৫ লক্ষ কন্যাভ্রূণ হত্যা প্রতি বছর। এর অধিকাংশ ভারত এবং চীনে। ভারতে সদ্যোজাত শিশুকন্যার মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১৩.৫।  ২০১১সালের জনগণনায় রিপোর্টে দেখা গেছে হাজার শিশুপুত্র অনুপাতে শিশুকন্যার সংখ্যা মাত্র ৯১৮! এই সংখ্যা  ক্রমহ্রাসমান। এর ভবিষ্যৎ পরিণতি ভয়াবহ। 

নারী নির্যাতন ভয়াবহ আকার নিয়েছে গোটা বিশ্বে। ঘরের নিরাপদ চৌহদ্দি নিরাপত্তা দিতে অক্ষম। প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন নারী নিজগৃহে নির্যাতিত হচ্ছেন। ২০১৭ সালের গোটা পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া নারীহত্যার, প্রতি তিনজনের একজন শিকার হয়েছেন গার্হস্থ্য হিংসার। বিশ্ব জুড়ে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা ক্রমবর্ধমান। বয়ঃসন্ধির  সময়ে ব্রেস্ট আয়রনিং থেকে শুরু  করে যোনীর ক্লিটোরিস কেটে দেওয়ার মতো নারকীয় প্রথা আজও বিলুপ্ত হয়নি। 

ভারতে ৩০.৯ শতাংশ নারী পারিবারিক হিংসার শিকার। ২. ৮ শতাংশ শ্লীলতাহানি এবং ১৭.৯ শতাংশ অপহরণের  শিকার। কন্যাশিশুদের প্রতি  অপরাধের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ২০১৮ থেকে ২০১৯ একবছরে বেড়েছে ৪.৫ শতাংশ। 

এখানেই শেষ নয় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর, ভয়াবহ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে প্রতিদিন গড়ে ৮৭ জন মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন আমাদের দেশে। ২০১৮ সালে নথিবদ্ধ মহিলা নিগ্রহের সংখ্যা ছিল ৩,৭৮,২৩৬টি, এক বছরে  অপরাধ ৭.৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪,০৫,৮৬১টি।

‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া -২০১৯’এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে  ঐ বছরে প্রতি একলক্ষ মহিলার মধ্যে ৬২.৪ শতাংশ অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। পকশো আইনের  ফাঁকফোকড়ে মুক্তি পেয়ে যায় নির্যাতককারী। ধর্ষিতাদের পোশাককে নির্যাতনের জন্য দায়ী করা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অথচ শিশুকন্যা থেকে অশতীপর বৃদ্ধা বিকৃতকামী পুরুষের লালসার শিকার সেখানে কি অশালীন পোশাককে অভিযুক্ত করা যায়? 

যৌনকর্মী হিসেবে নারীদের ব্যবহৃত হচ্ছেন  যুগযুগান্তর। লক্ষাধিক শিশুকন্যা যৌনকর্মী হিসেবে মনুষ্যতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। নিঠুর তথ্য  এদের অধিকাংশকেই  নিকটজনেরা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়। 

বিশ্ব শ্রম সংস্থার সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী মেয়েরা, সমবয়সী ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করে পরিবারের অন্ন সংস্থানে সহায়তা করলেও বঞ্চিত হয় অর্জিত অন্ন থেকে।

অথচ সভ্যতার শুরুতে সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কৃষির আবিস্কারের কৃতিত্ব কিন্তু নারীর। ক্রমশ  শারীরিকভাবে সক্ষম পুরুষের হাতে এলো পরিচালিকা শক্তি। নারীর অধিকার সন্তান প্রতিপালক আর গৃহকর্মে সঙ্কুচিত হলো। 

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে দেখা যায়, সিন্ধু সভ্যতার যুগে নারীর যথেষ্ট মর্যাদা ছিল। পুত্র কামনায় পুত্রোষ্ঠি যজ্ঞ হলেও কন্যাসন্তান তখনও সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে যায়নি। ঋকবৈদিক যুগে নারীর শিক্ষার্জনের অধিকার ছিল।বৈদিক নারী সুক্ত ও শ্লোক রচনা করেছেন ইতিহাসে তার উল্লেখ  আছে। পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকেই নারীর অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছে, মধ্যযুগে এসে নারী ক্রমশ অবগুণ্ঠনের আড়ালে চলে যেতে বাধ্য হলো। কন্যাসন্তানের জন্ম অভিশাপ মনে করা শুরু হল, শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। বাল্যবিবাহ, কৌলিন্যপ্রথা, সতীদাহ নারীদের চরম দূর্দশার কারণ হল। 

ব্রিটিশ শাসন শাপে বর হয়েছিল অন্তত ভারতীয় নারীদের ক্ষেত্রে। নারী  ফিরে পেলো শিক্ষার অধিকার। রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় সতীদাহপ্রথা রদ, বিদ্যাসাগরের অদমনীয় প্রচেষ্টায় বিধবা বিবাহ আইন পাশ হল। নারীসমাজের উন্নয়নে ব্রাহ্মসমাজ, ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর ভূমিকা  অনস্বীকার্য। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে বেথুন, বিদ্যাসাগর, সিস্টার নিবেদিতা প্রমুখের অক্লান্ত প্রচেষ্টা  ক্রমশ সমাজের মূলস্রোতে ফেরে নারী সমাজ।

এরপর এলো কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। বাহাত্তর বছর  পরে, স্থলে -জলে -অন্তরীক্ষে নারী তার বিজয়কেতন ওড়ালেও সমাজের সর্বস্তরের নারীর অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। 

নারী ততটুকু স্বাধীনতা পেয়েছে, যতটুকু পুরুষ তাকে দিয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল আধুনিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারী কর্মজগতে পা রেখেছে পুরুষের পাশাপাশি তবুও দিনের শেষে ঘরে ফিরে  ঘরকন্নার দায়িত্ব কেবল নারীর একার। আবার নারী শ্রমিকটি সমান শ্রম দিলেও পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় কম মজুরি পায় এটাই দস্তুর। এখানেই  আশ্চর্য  মিল উচ্চশিক্ষিতা কর্মরতা গৃহবধূটির সাথে নিরক্ষর মহিলা শ্রমিকটির! তবুও শেষরক্ষা হয় না। 'ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন উওম্যান'এর রিপোর্টে দেখা গেছে কোনো পরিবারে যদি স্ত্রীর আয় স্বামীর চাইতে বেশী হয়, এক্ষেত্রে স্বামী হীনমন্যতার শিকার হয়ে স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। শতকরা ৬৪ জন পরিস্থিতির ভুক্তভোগী। 

একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও একশ্রেণীর মানুষের কাছে নারীবাদ বিদ্রুপের বিষয়। নারীবাদ স্বেচ্ছাচার বা উশৃংখলতা নয়। নারীর সহজাত প্রবণতা ভাঙা নয় গড়া। নারীরা চান সংসার গড়তে, যে সংসারে থাকবে তার অস্তিত্ব, আত্মমর্যাদা সর্বোপরি ‘মেয়েমানুষ’ নয় মানুষের সম্মান।

(www.theoffnews.com - international women's day)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours