দেবস্মিতা ধর, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

সকাল শুরু হল সামনের ক্লাবের চোঙা থেকে নির্গত শচীনকত্তার কণ্ঠ নিঃসৃত সুরেলা বসন্তে। ঘুম চোখ কচলে মনযোগ সহকারে কান খাড়া করলাম। উপলদ্ধ হল, শচীনকর্ত্তা সেই কবেই প্রশ্নচিহ্ন রেখে গেছেন – 

‘রঙেতে রাঙিয়া, রাঙাইলে মোরে

এ কি তব হোরিখেলা ?’

বড়োই মনচোরা প্রশ্ন সন্দেহ নেই। তো নানান বর্ণে রাঙানো ও রঙীন হওয়ার, হৃদয় দোদুল্যমান করার সেই ঋতুরাজ বসন্তের আবাহন ‘দোলউৎসব’ বা ‘হোলি’ মানব জীবনসংসারে বড়োই প্রার্থিত ও স্বাগত। পুরাণ-রূপকথা-লৌকিক-অলৌকিক বিভিন্ন কাঁচের মধ্য দিয়ে এই ফাগের উৎসবকে দেখা যেতে পারে।

পূণ্যধাম ব্রজভূমির ধূলিকণা শ্রীরাধিকা ও শ্রীকৃষ্ণের লীলারঙে চিররঙীন। চিরপবিত্র। সেই লীলারই অন্যতম রূপ হোলি। শাশ্বত প্রেমের চিরন্তন মিঠে সুর ব্রজের অন্তরাত্মা, আর তা সপ্রকাশিত হয় এই ‘হোলি’ উৎসবে।

পৌরাণিক কথন অনুযায়ী, একদা কৃষ্ণ মা যশোদার কাছে এসে অনুযোগ করলেন, মা, রাধিকা কেন গৌরবর্ণা? আমি কেন কালো? মা যশোদা পড়লেন বিপদে। বর্ণের কারণেই হয়ত গৌরবর্ণা রাইকিশোরীর মন পাচ্ছেন না লীলাময় মদনমোহন। ব্যাকুল হলেন মা যশোদা। তিনি আবির এনে রাঙিয়ে দিলেন বাঁকেবিহারীকে। এও বললেন, কখনও কৃষ্ণও যেন এমনি করেই রাঙিয়ে দেন রাধিকাকে। তাহলেই রাখালরাজা আর রাইকিশোরীর বর্ণ এক হয়ে যাবে। মায়ের কথা মনে ধরলো যশোদাদুলালের। এক ফাল্গুনী পূর্ণিমায় তিনি সদলে পৌঁছলেন শ্রীরাধিকার গ্রাম বরষাণায়। ফাগে-গুলালে রাঙিয়ে দিলেন শ্রীমতী ও তার সখীদের। প্রত্যুত্তরে রাধা ও তাঁর সখীরা লাঠি হাতে তেড়ে এসেছিলেন নন্দগাঁওতে। সেই থেকে শুরু শ্রীক্ষেত্রে ‘লাঠমার হোলি’। ব্রজধামে ব্রহ্মাচল মন্দিরে শ্রীজীর মন্দির, স্থানীয়রা বলেন ‘লাডলিজি’র মন্দির, সেখান থেকে দোল উৎসব শুরু হয়। প্রথা অনুযায়ী এখনও এখানে মহিলারা গোপিনীর বেশে সেজে হোলি খেলতে নামেন। পুরুষরা সাজেন কৃষ্ণসখার বেশ। তাঁদের হাতে থাকে গোল গোল ঢাল। লম্বা বাঁশের লাঠি নিয়ে মহিলারা ঝাঁপিয়ে পড়েন পুরুষদের ওপর। পুরুষেরা মাটিতে বসে মাথায় ঢাল দিয়ে লাঠির আঘাত আটকান। এইসময় গাওয়া লোকগানকে বলা হয় ‘হোরি’। উত্তরপ্রদেশের বরষাণা, বৃন্দাবন, মথুরা, নন্দগ্রামে এই রীতি অনুসারেই হোলি খেলা হয়। বৃন্দাবনে হোলিকে বলে ‘ফাগ্বাহ’। পুতনা বধের স্মৃতিকে স্মরণ করে হয় ‘পুতনা দহন’। বৃন্দাবনের কোথাও কোথাও পঞ্চম বা ষষ্ঠ দোল পালন করা হয়।

পৌরাণিক কাহিনীর পাশাপাশি লৌকিক কথনও সমাদৃত হয়েছে এই প্রেক্ষিতে। বলা হয়, হোলি প্রাকবৈদিক কৃষিনির্ভর আদিম জাতির উৎসব। উৎসবটি এসেছে শবরদের থেকে। মনে করা হয় এই শবরোৎসবই প্রভাবিত করেছিল আর্যদের।

শস্যশ্যামলা বাংলায় ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে মহাসমারোহে পালিত হয় দোলপূর্ণিমা যা বাঙালিরা ‘বসন্তোৎসব’-নামে বরণ করে নেয়। এই পবিত্র তিথিতেই এ বঙ্গে আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। বাংলা ও ওড়িশায় এ দিন তাই গৌরপূর্ণিমা।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দোলের শুভারম্ভে দেহতাত্ত্বিকতার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতেই শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধিকা নিবিড় রতিক্রিয়ায় মত্ত হন। সেই প্রেমানুরাগের চিহ্ন পরের দিন সকালেও রয়ে যায় রাইকিশোরীর শরীর জুড়ে। এমনভাবে ঘরে ফিরলে লোকনিন্দা হবে। লজ্জা ঢাকতে বাঁকেবিহারী প্রিয়তমার শরীর আবির, গুলালে ভরিয়ে দিলেন। রঙের জোয়ারে ভাসলো ব্রজধাম। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে এভাবেই শুরু হয়েছিল হোলি উৎসব।

শুধু উত্তর ভারত নয়, বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম করে আবিরের রং ছড়িয়েছিল দাক্ষিণাত্যেও। রাজ্য তামিলনাড়ুতে হোলির পরিচয় ত্রিবিধ। ‘কামবিলাস’, ‘কামন পণ্ডিগাই’, এবং ‘কামদহন’। তিনটি নামেই রয়েছে ‘কাম’ শব্দটি। বৃন্দাবনে যিনি কানহা, তিনিই দক্ষিণে প্রেমের দেবতা কামদেব। এখানে হোলির সুরে বিরহ মিশে রয়েছে। পৌরাণিক কথনে বলা হচ্ছে, মহাযোগী মহেশ্বরের হৃদয় পার্বতীর জন্য প্রেমভাব সঞ্চারে মদনদেব শরবাণ নিক্ষেপ করেন। তাতে কৈলাসপতি প্রেমের বন্ধনে পড়লেও ধ্যানভঙ্গের রোষে তৃতীয় নয়নের অনলে ভস্মীভূত হলেন কামদেব। পরে রতির কাতর প্রার্থনায় মহাদেবের কৃপায় তনু ফিরে পান তিনি। কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানার মানুষের বিশ্বাস, পবিত্র অগ্নিতে যাঁকে দাহ করা হয় তিনি হোলিকা নন, কামদেব। প্রেমের দেবতার পুনরায় ফিরে আসাকে উপলক্ষ্য করে বসন্ত পঞ্চমী উৎসবের চল্লিশ দিন পর হোলি উদযাপিত হয়।

রঙীন রাণী মুখার্জীর লাস্যময় ইঙ্গিতে পেশিবহুল সলমন খান মানব পিরামিডে চড়ে ঠাণ্ডা লস্যির হাঁড়ি ভাঙছেন – ‘হ্যালো ব্রাদার’ সিনেমার সেই দৃশ্য মনে পড়ে ? হ্যাঁ, মহারাষ্ট্রের হোলি ‘মটকি তোড়’। বালগোপালের ননী চুরি দুষ্টুমির কথা মাথায় রেখেই প্রতি বছর ‘মটকি তোড়’- এ মেতে ওঠে পশ্চিমের এই রাজ্য। গুজরাটে এর নাম ‘ধুলোটি’। মণিপুরের হোলির নাম ইয়াওসাং, অসমে এর নাম ফাকুওয়া। ছোট রাজ্য গোয়ায় এর নাম সিগমো। এটি শিশিরোৎসব নামেও পরিচিত। মালয়ম ভাষায় এর নাম ‘মঞ্জলকুলি’। এইভাবে ভারতবর্ষের প্রাচীন উৎসব হোলির নামবৈচিত্রের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত সুরের ঐক্য একটি তারে বাঁধা পড়ে। আর সেটি হল প্রেমের সুর, ভালোবাসার রঙীন মঞ্জরী। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে সপ্তদশ শতাব্দীতে হর্ষবর্ধনের লেখা ‘রত্নাবলী’ নাটক কিংবা আলবেরুণির ‘ভারত-তত্ত্ব’, হোলির বর্ণনায় রঙীন হয়েছে পৃষ্ঠা।

হোলি আসলে জাতি-ধর্মের বিভেদ রং ভুলে প্রাণের-প্রেমের অভেদ বর্ণে একাত্ম হওয়ার মিলনপ্রাঙ্গন। নদিয়ায় নিমাইয়ের কণ্ঠের আকুল সুরে আর আমাদের প্রাণের কবি রবি ঠাকুরের কলমে বড়ো সার্থক ছন্দে ধরা পড়েছে এই উৎসবের রঙীন তান। তাই এই রং শুধু শরীরকে নয়, আমাদের মর্মে, জীবনের সকল কর্মকে ছুঁয়ে অন্তরাত্মাকে পূর্ণতার পথে বিকশিত করুক, বসন্তের এই মাহেন্দ্রক্ষণে এটাই আন্তরিক কামনা।

অন্ততঃ একদিনের রঙের উৎসব যেন কারোর বাকি দিনগুলোকে রঙহীন না করে দেয়, সেটা দেখাও কিন্তু আমাদেরই দায়িত্ব।

(www.theoffnews.com - dol holi)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours