পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা: 

শালের জঙ্গল জুড়ে এখন কচি পাতার বিস্তার, গাছে গাছে শাল ফুলের মেলা। কালো পিচঢালা পথে ঝরা শাল ফুলের দৌলতে হলুদের প্রলেপ। শাল ফুলের সেই মিষ্টি গন্ধে এই সময় গোটা জঙ্গল মহল জুড়েই হালকা সুগন্ধ উড়ে বেড়ায়। এবার কিন্তু শালের সেই গন্ধ ছাপিয়ে উড়ছে ভোটের গন্ধ।

কাকড়াঝোরের দিকে একটা কালো পিচঢালা পথ শালের জঙ্গলের ভিতর দিয়েই চলে গিয়েছে চাকাডোবার দিকে। পথেই পড়ে ময়ুরঝর্ণা গ্রাম। বুধিয়া সোরেনের বাড়ি সেই গ্রামেই। মহুয়া কুড়োচ্ছি দেখে নিজে থেকেই কথা বলতে এল সে। সাংবাদিক মানুষ, দুটো একটা কথার পরই চলে এলাম ভোট প্রসঙ্গে। কি বুঝছেন? কলকাতা সুলভ এই প্রশ্ন করতেই দেখলাম স্পষ্টতই চিন্তায় পড়ে গেল বুধিয়া। গত দশ বছরে জঙ্গল মহলে কাজ হয়েছে তা বুধিয়ার কথাতেই স্পষ্ট। রাস্তাঘাট ভাল হয়েছে, সরকারি টাকায় চাল মিলছে, স্কুলে ছেলেমেয়েদের যাওয়ার হারও বেড়েছে। জীবনযাত্রায় একটা পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে। সব থেকে বড় কথা জঙ্গল মহল জুড়ে যে মাও হানা বা ভয়ের বাতাবরণ ছিল তা অনেকটাই দূর হয়েছে। পর্যটনেও জোয়ার এসেছে। সব মিলিয়ে জঙ্গল মহল হাসছে। সত্যিই কি হাসছে? এটাই বুধিয়ার চিন্তা। মাও হানা এখন ইতিহাস জঙ্গল মহলে, অন্তত শাসকের খাতায় কলমে তেমনটাই বক্তব্য। কিন্তু ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই অঞ্চলগুলিতে এখনও রাতের অন্ধকারে মাঝে মধ্যেই তাদের আনাগোনার গন্ধ মেলে। চোখের সামনে মানুষকে মরতে বা মারতে দেখেছেন বুধিয়ারা। মানুষ মেরে সগর্বে বন্দুক কাঁধে ঘুরে বেড়াতো যারা তাদের অনেকেই এখন মূল স্রোতে। সিংহ ভাগই পুলিশে বা হোমগার্ডে। এখানেই বুধিয়ার প্রশ্ন, এত মানুষ মেরেও এই ভাবে সরকারি চাকরি মেলে? 

বুধিয়ার মতই একই প্রশ্ন সঞ্জয়ের মুখেও। বারিকুলের সঞ্জয় কিস্কু অবশ্য ময়ুরঝর্ণার বুধিয়াকে চেনে না। চেনে বছর দশেক আগেকার সেই সন্ত্রাসের দিনগুলিকে। একটা সময় রাতের বেলা তো বটেই দিনের বেলাতেও সন্ত্রস্ত শঙ্কিত হয়েই দিন কাটাতে হত তাদের। এক সময় বিল্পবী ক্ষুদিরাম তাদের এই ছেঁদাপাথর গ্রামে এসে লুকিয়েছিলেন। একটা প্রছন্ন গর্ব আছে সেই কারনে। কিন্তু ক্ষুদিরামের বহুবছর পরে মাওবাদীরাও লুকিয়ে থাকত পাথর খাদানের জঙ্গলাকীর্ণ গুহাগুলিতে। সে বড় সাঙ্ঘাতিক সময়। গ্রামের বহু ছেলে মেয়েকে তারা নিয়ে গিয়ে হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিয়েছিল। নিজের সহপাঠী, খেলার সঙ্গীদের বন্দুক হাতে হত্যালীলায় উল্লসিত হতে দেখে শিউরে উঠেছেন সঞ্জয় কিস্কু এবং অন্যরা। আজ সেই হত্যাকারীরা পুলিশে যোগ দিয়ে আইনের রক্ষাকারী। এটা যেন মন থেকে ঠিক মেনে নিতে পারেন না জঙ্গল মহলের অনেকেই। 

জঙ্গল মহলে মাওবাদীদের দৌরাত্ম্য এখন নেই বটে, কিন্তু একেবারেই বিনা শাস্তিতে এই পুনর্বাসন হজম করতে অসুবিধা হয় সেই সব মানুষদের যাদের প্রিয়জনেরা এক সময় এদের হাতেই প্রাণ দিয়েছেন। একের পর এক মানুষ হত্যা করা, সরকারী সম্পত্তি নষ্ট করা, অবাধে লুঠ পাট চালানোর পরেও জুটেছে সরকারী চাকরি। অথচ সাধারণ মানুষ যারা সেই সময়ে ভয়ে শঙ্কায় দিন কাটিয়েছেন তাদের এখনও দিন আনা দিন খাওয়ার লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই যেতে হচ্ছে অনবরত। এটাই জঙ্গল মহলকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলেছে। 

শান্তি এসেছে, কিন্তু তার বিনিময়ে এসেছে এই এক অশান্তিও। এর উপরে আছে ভুঁইফোঁড় তৃণমূল নেতাদের চোখ রাঙানি, বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ, সাধারণ মানুষের উপরে অত্যাচার। তাই তো এর প্রভাব পড়েছিল গত লোকসভা নির্বাচনে। গোটা জঙ্গল মহল প্রবল বিতৃষ্ণায় শাসক বিরোধী ভোট উজাড় করে দিয়েছিল। জঙ্গলের প্রান্তিক মানুষগুলি সরল, সাধাসিধে। তারা যদি মনে করেন এই মানুষটি ভালবাসার যোগ্য তবে প্রাণ ভরিয়ে তার বা তাদের জন্য করতে পিছপা হন না। কিন্তু সেই বিশ্বাস ভাঙলে, একবার মন উঠে গেলেই শেষ। আর ঘুরে তাকাতেও চান না। তৃণমূলের ক্ষেত্রে এটাই দুশ্চিন্তার কারণ জঙ্গল মহল জুড়ে। সেই বিশ্বাসে কোথাও যেন চিড় ধরেছে। এই সুযোগটাই নিয়েছে বিজেপি। তাদের নানা ধরনের কেন্দ্রীয় জনবিরোধী নীতি বা অপশাসনের প্রচার তাই ধাক্কা খায় জঙ্গল মহলে এসে। প্রান্তিক মানুষগুলির কাছে ব্যাঙ্কের সুদ কমা, পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, সরকারী প্রতিষ্ঠান বিক্রির চেয়েও স্থানীয় নেতাদের ঔদ্ধত্য, তোলাবাজি বা কাটমানি নেওয়া অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। 

এবারের ভোটে তাই জঙ্গল মহল একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত, খানিকটা সংশয়ে। নতুন পুরনোর দ্বন্দে শাল বনে যেন গুমোট। পলাশ রঙা বসন্তে পড়ন্ত বিকেলের মিঠে হাওয়াতেও কাটছে না সেই গুমোট ভাব।

(www.theoffnews.com - West Bengal election jangal Mahal vote)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours