তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই (১৮৬১-১৯৪১) বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের প্রথম ছড়া সংগ্রাহক। ছড়া সংগ্রহ করে তিনি এর ওপর একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন। এ ছড়াগুলো প্রধানত মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তাই রবীন্দ্রনাথ প্রথমে এ ছড়াগুলোর নাম দেন ‘মেয়েলি ছড়া’; এ নামেই তাঁর প্রবন্ধ লেখেন। পরে লোকসাহিত্যে এ ছড়াগুলোর নামকরণ করেন ‘ছেলেভুলানো ছড়া’। এ ছড়াগুলো তাঁর সাহিত্যজীবনের ওপরও প্রভাব ফেলেছিল। মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, গল্পগুচ্ছ এবং বিসর্জন ঠিকভাবে বুঝতে গেলে মনে রাখতে হবে লোক সাহিত্যের রস। অর্থাৎ জমিদারী জনপদে আসবার পর তাঁর প্রথম পাঠ এই লোকজীবন। তিনি এ সময় উপলব্ধি করেন বাংলাদেশের আটপৌঢ়ে মানুষের মধ্যে যে অনাড়ম্বর সাহিত্য প্রচলিত আছে, তা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এবং এগুলো তাঁর জীবনে প্রভাবও ফেলে। এগুলো তিনি ছড়িয়ে দিতে চান ভদ্র-শিক্ষিত মহলে। এবং ১৮৯৪ সালের ১ অক্টোবর চৈতন্য লাইব্রেরিতে ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ পাঠ করে লোকসাহিত্য বিষয়ে শিক্ষিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

ছড়ায় বাংলার ইতিহাস বলতে এই ইতিহাস প্রায় দেড়হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে ছড়ার বিকাশ ও উৎকর্ষ আমাদের বারবার চোখে পড়ছে। আদিতে সাহিত্য রচিত হতো মুখে মুখে এবং ছড়াই ছিল সাহিত্যের প্রথম শাখা বা সৃষ্টি। সাহিত্য লেখ্যরূপে পাওয়ার পূর্বে ছড়ায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতো। লোকসমাজে ছড়াই ছিল ভাবপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। গদ্য সাহিত্যের আগে তাই কেউ কেউ ছড়াকে লৌকিক সাহিত্য বলে বিবেচিত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন—'ছড়া শিশুদের খেলামেলার কাব্য'। আধুনিক সাহিত্যিকগণ এসব অভিধান মানতে নারাজ। তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের মতো ছড়াও সাহিত্যের একটি প্রয়োজনীয় শাখা। এই শাখাটি অন্যান্য শাখার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্যতা সহজেই ধরা পড়ে।

ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তার 'লোক সাহিত্য' গ্রন্থে ছড়াকে লৌকিক ছড়া, সাহিত্যিক ছড়া ও আধুনিক ছড়া—এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এছাড়াও ছড়াকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা হয়। যেমন- শিশুতোষ ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া, ছড়ার ছন্দাশ্রিত কিশোর কবিতা প্রভৃতি। এর মধ্যে শিশুতোষ ছড়া তৈরি হয় কেবলমাত্র শিশু-মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে।

বাংলা সাহিত্যের আদিসৃষ্টি বা নিদর্শন চর্যাগীতির প্রথম পদটি ছড়ার মূলছন্দ স্বরবৃত্তে লেখা এবং এটি ছন্দ-মিলে রচিত। এই পদটি বাংলা সাহিত্যের আদিছড়া বললেও ভুল হবে না। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার লৌকিক ছড়াকে প্রথম গ্রন্থভুক্ত করেন এবং গ্রন্থটির নাম দেন 'খুকুমণির ছড়া'। এই গ্রন্থটির ভূমিকায় সর্বপ্রথম রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থে সুকুমার রায়ের ছড়া সংকলিত করে ছড়ার গ্রহণযোগ্যতাকে মজবুত করেন। ছড়া প্রসঙ্গে কবিগুরু বলেছেন, ‘সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা অর্থেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মধ্যে। সেইজন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।’ একসময় ছড়াকে মনে করা হতো শুধুই শিশুসাহিত্য। তবে এখন আর তা মনে করা হয় না, বাংলা সাহিত্যে ছড়া তার নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে আধুনিক কালের সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনেকেই ছড়া লিখেছেন। আবার কখনও ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের খেলার অঙ্গ হিসেবে রচনা হয়েছে ছড়া। যেমন, 'এলাটিং বেলাটিং সই লো, কিসের খবর আইল' ইত্যাদি। সাহিত্যচর্চার মতো ভেবেচিন্তে কথা বসানো নয়, শব্দের চলন এখানে নিশ্বাস–প্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। এমনকি কোনও ইতিহাস লেখার জন্য ভেবেচিন্তে কিছু করা হয়নি। তবু ছড়াগুলিতে রয়ে গিয়েছে নানা সমসাময়িক ঘটনার প্রভাব, যার সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট। আমরা উদাহরণ হিসাবে প্রথমে খুব চেনা-জানা একটা ছড়া দেখি। -

আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে।

ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে।।

বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।

ঢুলি গেল সেই কমলাফুলি।।

কমলাফুলির টিয়েটা।

সুয্যিমামার বিয়েটা।।

আয় রঙ্গ হাটে যাই।

এক খিলি পান কিনে খাই।।

পানের ভিতর ফোঁপড়া।

মায়ে ঝিয়ে ঝগড়া।।

কচি কচি কুমড়োর ঝোল

ওরে খুকু গা তোল।।

জ্যোৎস্নাতে ফটিক ফোটে, কদম তলায় কে রে।

আমি তো বটে নন্দ ঘোষ, মাথায় কাপড় দে রে।।

হলুদ বনে কলুদ ফুল।

মামার নামে টগর ফুল॥

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছেলেভুলোনোর ছড়া’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই ছড়াটির প্রথম কয়টি ছত্রে বিবাহ যাত্রার বর্ণনা আছে। আগে অভিজাত পরিবারের বিবাহের শোভাযাত্রা ছিল যুদ্ধযাত্রারই পরিবর্তিত রূপ। কারণ একটা সময় জোর করে মেয়েদের তুলে আনা হত। বিজয়ী গোষ্ঠীর লোক বিজিত গোষ্ঠীর মেয়েদের বিয়ে করবে, এমন প্রথা ছিল। আজও কিছু অবাঙালিদের বিয়েতে ঘোড়ায় চেপে হাতে তরোয়াল নিয়ে বিবাহ করতে যাওয়ার রীতি আছে। এই ছড়াটিতে সেই বিবাহযাত্রারই একটি রূপের বর্ণনা পাই আমরা। কৃত্তিবাসী রামায়নেও এমন বীররসাত্মক বর্ণনায় বরযাত্রীদের শোভাযাত্রার কথা বলা আছে। এমনকি তখনকার দিনে বিয়েতেও জয়ঢাক যে বাজানো হত, তার উল্লেখ আছে ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে। কিন্তু মূল ছড়ার প্রথম অংশ আসলে ‘ডোম চতুরঙ্গের’ বর্ণনা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের ‘বেনের মেয়ে’ গ্রন্থে আমরা এই ছড়ার একটি অন্য রূপ আমরা পাই -

“আগডোম, বাগডোম, ঘোড়াডোম সাজে।

ডাল মৃগল ঘাঘর বাজে,

বাজতে বাজতে পড়লো সাড়া

সাড়া গেল বামনপাড়া”।

(একাদশ পরিচ্ছেদ, দ্বিতীয়াংশ)

এবার আসি সেই ইতিহাসের ভুলে যাওয়া গল্পে, যা প্রচ্ছন্নভাবে ধরা আছে এই ছড়ায়। সাতগাঁ বা সপ্তগ্রামের বাগদী রাজা, রূপারাজা যখন হরিবর্মার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, তখন হুকুম দিলেন ‘‘সব বাগদী সাজ’’। রূপারাজার ছিল বাগদী ও ডোম সেনা। বাগদী সেনারা লড়াই করে, কিন্তু ডোম সেনারা রাস্তা তৈরি করে, শত্রুর উপর নজর রাখে। একসময় এই ডোম সেনারাই বাংলার পশ্চিম-সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী ছিল। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের, রাজনগরের সামন্তরাজাদের ডোম সেনা ছিল। 'আগডোম' মানে অগ্রবর্তী ডোম সৈন্যদল, ‘বাগডোম’ মানে বাগ বা পার্শ্বরক্ষী ডোমসেনা এবং ‘ঘোড়াডোম’ মানে অশ্বারোহী সৈন্যদল। যুদ্ধের দামামা বাজলেই এই ডোমসেনারা গিয়ে রাস্তা পর্যবেক্ষণ করতেন, রাস্তা বানাতেন আর ঘোড়ায় চেপে দেশের অবস্থা-পরিস্থিতির উপর নজর রাখা শুরু করতেন। এই ডোম জাতি রাঢ় অঞ্চলের সেই সমস্ত তথাকথিত অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর শরিক, যারা একদিন নির্ভীক বীরের মতো যুদ্ধ করতেন সমাজের উঁচু তলার রাজা, মহারাজা ও সামন্তপ্রভুদের জন্য। তাঁদেরই বীরত্বের বলে প্রভুরা হতেন ‘অরি-বিমর্দন’, ‘সসাগরা ধরণিপতি’ আর থাকতেন নিরাপদে। এই সব প্রভুদের  বা রাজাদের কথা ইতিহাদের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও, ডোমসেনাদের বীরগাথা ঠাঁই পায়নি কোন ইতিহাস বই বা তাম্রশাসনে। লেখা আছে তুর্কি আক্রমণে বীর মল্ল রাজাদের কথা। কিন্তু এই বাগদী ও ডোম সেনাদের বীরগাথা লুকিয়ে আছে বাংলার ছোট ছোট ছেলেদের খেলার ছড়ায়, আছে লোকসঙ্গীতে, লোকগাথা ও রাঢ় বাংলার মঙ্গলকাব্যে, যেগুলিকে অনেকেই ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না।

আজকের সাবাল্টআর্ন স্টাডি দেখিয়ে দিয়েছে নিন্ম বর্গের ওপর উচ্চ বর্গের অত্যাচার এই ভাবে দেখতে হবে। এরাই হল সেকালের নিপীড়িত শ্রেণী। আশ্চর্য জনক ভাবে ইতিহাস নীরব এদের সম্পর্কে। এই ছেলে ভোলানো ছড়াতেই ধরা আছে সেই ডোমসেনাদের সীমান্তরক্ষার কাহিনি। মধ্যযুগের বাংলার লৌকিক সাহিত্যে এইরকম অনেক ডোম বীরের শৌর্যের কাহিনী আছে। ‘ধর্মমঙ্গল’–এ কালু ডোম ও লখাই ডোম এর উদাহরণ আছে। তাই ছড়াটিকে আমরা ইতিহাসের স্বাক্ষর বলতেই পারি। তারপর একদিন এই ডোম সৈন্যদলের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ফুরোল, আর আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেলেন এই সেনারা। তাই এই ছড়ার মূল অর্থ অনেকেই হয়তো বুঝতে পারেন না।

ঘরের ভিতরে সময় কাটানোর জন্য ছোটদের খুব জনপ্রিয় একটি খেলা ‘ইকিড়-মিকিড়’। বৃষ্টি-বাদলা, ঝড়জলের সময় যখন বাড়ির বাইরে যাওয়া যেত না, সেইসব দিন কাটাতে এই খেলার জুড়ি ছিল না। এর সঙ্গে যে আমরা বলতাম —

ইকিড় মিকিড় চামচিকির

চামে কাটা মজুমদার।

ধেয়ে এল দামোদর।

দামোদরের হাঁড়ি কুঁড়ি

দুয়ারে বসে চাল কুড়ি।

চাল কুড়িতে হল বেলা

ভাত খেয়ে যা জামাইশালা।

ভাতে পড়ল মাছি,

কোদাল দিয়ে চাঁছি।

কোদাল হল ভোঁতা

খা খ্যাঁকশিয়ালের মাথা।

নিতান্ত শিশুদের খেলার ছড়া। তবু এই ছড়াটিও ধরে রেখেছে ইতিহাসের একটি স্বল্প আলোচিত অধ্যায়। ছড়াটিতে ধরা আছে বাংলায় মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস।

মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর সেনাপতি মানসিংহকে বাংলায় পাঠালেন বাংলার বারো ভুঁইঞাদের অন্যতম প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করতে। মানসিংহ জলঙ্গী নদী পেরিয়ে আসতে গিয়ে পড়লেন ঝড়ের কবলে। তখন তাকে সাহায্য করলেন তিনজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের প্রত্যেকেরই পদবি ছিল ‘মজুমদার’। তারা হলেন, ভবানন্দ মজুমদার, লক্ষীকান্ত মজুমদার এবং জয়ানন্দ মজুমদার। এঁরা তিনজনেই মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন। এঁদের মধ্যে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা, হুগলির কানুনগো দপ্তরের মুহুরি ভবানন্দ মজুমদারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়। ভবানন্দ মানসিংহকে নৌকো দিয়ে নদী পার হতে সাহায্য করেন। নিজের বাড়িতে তাঁকে নিয়ে আসেন ও বিশাল সৈন্যবাহিনীকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ফলে ‘চামচিকির’ কথাটার মানে যে বিশেষ সুবিধের নয় তা বোঝা সহজ। ‘চামে কাটা’ মানে যার ‘চামড়া নেই’ বা নির্লজ্জ–বেহায়া। আর ইঙ্গিতটি মানসিংহের সাহায্যকারী মজুমদারের প্রতি।

দামোদরের বন্যা তো একটা সময় প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। তাই কোনও নদীর বর্ষায় ফুঁসে ওঠা বা তার ভয়ঙ্কর রূপকে দামোদরের ধেয়ে আসার সাথেই তুলনা করা হত। আর তাই ঝড়বৃষ্টির রাতে ফুঁসে ওঠা জলঙ্গীকে এখানে দামোদরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

মানসিংহ ও তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীর খাওয়া-দাওয়ার যে বিপুল আয়োজন তা ভবানন্দ মজুমদার হাসিমুখে করলেও তার তাঁর পাকশালের কাজের লোকেদের অবস্থার কথাও হয়তো ধরা আছে ছড়ায়। রান্নার ব্যবস্থা করতে তাদের বেলা গড়িয়ে যেত। আর বাংলার ভুঁইঞাকে আক্রমণ করতে আসা মানসিংহকে যে বাংলার মানুষ নেকনজরে দেখবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক। আর ভারত সম্রাটের সেনাপতিকে যে ভবানন্দ ‘জামাই’ আদরে রেখেছিলেন এটাও তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। যেহেতু ছড়াগুলির উৎপত্তিকালের কোনও লিখিত ইতিহাস নেই, তাই এই বিশ্লেষণগুলি নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে। তবে প্রতাপাদিত্য, ভবানন্দ আর মানসিংহের এই সংঘাতের ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে কোনও সংশয় নেই।

উপেনটি বাইস্কোপ

উপেনটি বাইস্কোপ

নাইন টেন টাইস্কোপ

চুলটানা বিবিয়ানা

সাহেব বাবুর বৈঠকখানা।

বাবু বলেছেন যেতে

পান সুপারি খেতে।

পানের ভিতর মৌরি বাটা

ইস্কাপনের ছবি আঁটা।

আমার নাম যদুমণি

যেতে হবে অনেকখানি।

এই খেলাটি কয়েক প্রজন্ম আগে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে খেলেননি এমন কোনও মেয়ে পাওয়া বিরল। দু’জন রাজার উঁচুতে রাখা ইংরেজি হরফ ‘ভি’-এর মতো হাতের ফাঁক দিয়ে সবাইকে বৃত্তাকারে ঘুরতে হয় আর ছড়াটি শেষ হতেই একজন ধরা পড়তেন তাদের হাতের ফাঁকে। আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনও মানে না বোঝা গেলেও ওই সাহেব বাবুর বৈঠকখানায় যদুমণির পান-সুপারি খেতে যাওয়ার নিমন্ত্রণের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক করুণ ইতিহাস। এই দেশে একটা সময় পর্তুগিজ ও ইংরেজ সাহেবদের মধ্যে এদেশীয় মেয়েদের রক্ষিতা বা বিবি হিসেবে রাখার একটা চল ছিল। আর তা যে তারা সোজা পথে করতেন, তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কখনও কখনও গ্রামবাসীরা ভয়ে নিজেদের বাড়ির মেয়ে তাদের সমর্পণ করতেন বা আবার কোথাও-কোথাও সাহেবরা বলপূর্বক এটি করতেন। আবার এই মেয়েদের তারা ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রিও করে দিতেন।

এই ছড়াটিতে সাহেবদের বৈঠকখানার সেই আমোদ-প্রমোদের তাসের আসরে যদুমণিদের রক্ষিতা হয়ে যাওয়ার চিত্রই ফুটে উঠেছে। বাঙালি মেয়েদের এই লাঞ্চনার ইতিহাসই লেখা আছে এই ছড়ায়। তবে ‘বাইস্কোপ’ কথাটির সংযোজন থেকে মনে হয় যে, এই কথাটি হয় পরবর্তী সংযোজন বা হীরালাল সেনের হাত ধরে এদেশে বায়োস্কোপ আসার পরবর্তীকালের সৃষ্টি।

এলাটিং বেলাটিং সইলো ...

এটিও একটি মেয়েদের খেলার ছড়া। সমান সংখ্যক মেয়ে নিয়ে দু’টি দলে ভাগ হয়ে খেলা এই খেলার নিয়ম। খেলার নিম্নলিখিত ছড়াটি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বলা হয়—

প্রথম পক্ষঃ এলাটিং বেলাটিং সইলো।

দ্বিতীয় পক্ষঃ কীসের খবর আইলো?

প্রথম পক্ষঃ রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো।

দ্বিতীয় পক্ষঃ কোন বালিকা চাইল?

প্রথম পক্ষঃ অমুক বালিকা চাইল।

দ্বিতীয় পক্ষঃ কী প’রে যাবে?

প্রথম পক্ষঃ বেনারসী প’রে যাবে।

দ্বিতীয় পক্ষঃ কীসে ক’রে যাবে?

প্রথম পক্ষঃ পালকি ক’রে যাবে।

দ্বিতীয় পক্ষঃ কত টাকা দেবে?

প্রথম পক্ষঃ হাজার টাকা দেবে।

দ্বিতীয় পক্ষঃ নিয়ে যাও নিয়ে যাও বালিকা।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেই অর্থের বিনিময়ে মেয়ে কেনাবেচা চলত। রাজা বা জমিদাররা অর্থের বিনিময়ে নিজেদের ভোগের জন্য গরিব ঘরের মেয়েদের কিনতেন। দিল্লিতে এরকম মেয়ে কেনা-বেচার বাজার ছিল। সমাজের এক করুণ ঘটনা খেলাটির ও ছড়াটির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।

শেষে একটি ঘুমপাড়ানি ছড়া বা ছেলে ভোলানো ছড়ার কথা বলব। এই ছড়া শুনে ঘুমোয়নি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমাদের সকলেরই ছোটবেলার সঙ্গে এই ছড়া জড়িয়ে আছে।

ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে,

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?

ধান ফুরলো, পান ফুরলো, খাজনার উপায় কি?

আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।

এই ছড়াটির মধ্যে লুকিয়ে আছে মরাঠারাজ রঘুজি ভোঁসলের নেতৃত্বে ১৭৪১ সালের অগস্ট মাস থেকে ১৭৫১-র মে মাস পর্যন্ত মরাঠা বর্গীদের দ্বারা ছ’বার বাংলা আক্রমণের ইতিহাস। মরাঠা বর্গীদের এই আক্রমণে বাংলা ও বিহারে প্রায় চার লক্ষ প্রান চলে গিয়েছিল এবং প্রভূত ধন-সম্পত্তি লুঠ হয়েছিল। মহিলাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল। বাংলার নবাবের সঙ্গে চৌথ আদায়ের চুক্তিতে সন্ধি হলে আক্রমণ বন্ধ হয়। ছড়ার মধ্যে খাজনা আদায় সংক্রান্ত উদ্বেগও স্পষ্ট। পূর্ববঙ্গে বর্গী আক্রমণ হয়নি। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চল অবধি এই আক্রমণ চলে। এই সময় বহু মানুষ কলিকাতা ও বহু মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন। সম্ভবত তাঁরাই ছড়াটি পূর্ববঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন।

আমাদের গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে এমন অজস্র ছড়া লুকিয়ে আছে। ইতিহাস শুধু রাজা-রানির কথা বলে, কিন্তু এই ছড়াগুলো বলে সাধারণ মানুষদের কথা। তাই এই ছড়াগুলি হারিয়ে গেলে এই ইতিহাস হারিয়ে যাবে। লোকছড়ায় বৃহত্তর জীবন ও সমাজসত্য কীভাবে লুকিয়ে থাকে, নিচের উদ্ধৃতিদ্বয় থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায় –

ক. খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো

বর্গী এলো দেশে,

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে

খাজনা দেবো কিসে?

ধান ফুরুল পান ফুরুল

খাজনার উপায় কি?

আর কটা দিন সবুর করো

রসুন বুনেছি।

খ. খোকামণির বিয়ে দেব হটমালার দেশে

তারা গাই বলদে চষে।

তারা হীরেয় দাঁত ঘষে

রুই মাছ পালঙের শাক ভারে ভারে আসে।

– প্রথম ছড়াটিতে নবাব আলীবর্দী খাঁর শাসনামলে, ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে, বর্গীদের হামলা ও লুটতরাজের কথা প্রকাশিত হয়েছে। ছড়াটি যদিও শিশুদের ঘুম-পাড়ানোর উদ্দেশ্যে রচিত, তবে এখানে বাংলার সমাজ-ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায়ও সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ছড়াংশটিতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থার ছবি।

লোকছড়ার চারিত্র্য থেকে বাংলা ছড়াকে প্রথম আধুনিক মাত্রায় অভিষিক্ত করেন মনস্বী অন্নদাশঙ্কর রায়। দেশ-বিভাগের ডামাডোলের মধ্যে রাজনীতিবিদদের সংকীর্ণ স্বার্থচেতনা ও ভেদনীতিকে তীব্রভাষায় আক্রমণ করে অন্নদাশঙ্কর লিখলেন –

তেলের শিশি ভাঙলো ব’লে

খুকুর ’পরে রাগ করো,

তোমরা যে সব বুড়ো খোকা

ভারত ভেঙে ভাগ করো –

তার বেলা, তার বেলা?

– স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, এ-ছড়ার পেছনে ক্রিয়াশীল আছে একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই ছড়াটির সূত্রেই চল্লিশের আধুনিক ছড়া সম্পর্কে গবেষক লিখেছেন – ‘যে ছড়া ছিলো শুধুমাত্র গ্রামীণ লোকজ জীবন-ধারণের অন্যতম প্রকাশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে দেশবিভাগ সেই ছড়াসাহিত্যকে গ্রামীণ জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছে। ছড়ার ভাষা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম হাতিয়ার’ (নাগরী, ১৯৮৬ : ১১)।

শুধু ছড়াগুলি কেন, হা-ডু-ডু, গাদি, কুমিরডাঙা, এক্কাদোক্কা ইত্যাদি অনেক খেলার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এমন ইতিহাস যার সমাজত্বাত্তিক ও নৃতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বাংলার বহু মনীষী এই ছড়াগুলির গুরুত্বের কথা বলে গেছেন। তাই শুধু ছড়া সংকলন নয়, তার সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলির পুনরুজ্জীবনের চেষ্টাও করা দরকার। তা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের শিকড়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবে।

(www.theoffnews.com - Bengali rhymes history)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours