রমা চক্রবর্তী, শিক্ষিকা, আবৃত্তিকার ও ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

আজ ২৬শে জানুয়ারী ২০২১, প্রজাতন্ত্র দিবস মহাসমারোহে সমগ্র ভারতবর্ষে পালিত হচ্ছে,  এবছর ৭২ তম প্রজাতন্ত্র দিবস।

প্রতি বছর এই প্রজাতন্ত্র দিবস এলেই ছোটোবেলার বেশ কিছু স্মৃতি জীবন্ত/তাজা হয়ে ওঠে। বাবার চাকরি সূত্রে আমর দুর্গাপুরের M.A.M.C (Mining & Mecheinary Corporatin Ltd)তে জন্ম ও বড়ো হয়ে ওঠা। এইদিনটাতে আমাদের টাউনশিপ তথা দুর্গাপুর শিল্পনগরী যেন অপরূপ সৌন্দর্যে সেজে উঠতো। সবজায়গায় প্যারেড, মার্চপাস্ট, ক্রীড়া প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হতো। আমাদের M.A.M.C কারখানার গেটে পতাকা উত্তোলন, মার্চপাস্ট, প্যারেড এসবের ব্যবস্থাপনা চলতো। আমরা স্কুলে যেতাম সকাল ৮--৮.৩০ মি:, স্কুলে পতাকা উত্তোলনের পর আমরা আমাদের M.A.M.C স্টেডিয়ামে চলে আসতাম।সেখানেও  পতাকা উত্তোলন, প্যারেড হওয়ার পর ক্রীড়া প্রতিযোগীতা চলতো সারাদিন ধরে।

খেলাধূলার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল না, আমি আবৃত্তি প্রতিযোগীতা, নাটক এইসবে আগ্রহ ছিল ফলে এই সময় বেশ কয়েকদিন ধরে এই সব সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতা চলতো। আমার দিদি আবার খেলাধূলায় বেশ কয়েকটি পুরস্কার প্রাপ্তি ঘটাতো। আমি আবার ছোটোতে Go As You Like  এ অংশগ্রহণ করতাম এবং পুরস্কার ও পেতাম। সারাদিন ধরেই একটা সুন্দর পরিবেশের মধ্যে কাটাতাম।

কিন্তু এখন সবই অতীত, এখন দুর্গাপুর শহর অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। অনেক Shopping Mall, English Medium School, Flat Culture, Private Hospital গড়ে উঠেছে এবং শহরের চেহারার অনেক পরিবর্তন ঘটলেও আমাদের ছোটোবেলায় দেখা ২৬শে জানুয়ারী দুর্গাপুর শহরের জৌলুস অনেকটাই কমে গেছে। একদা যে দুর্গাপুর শহর ছিল সমগ্র ভারতের রূঢ় শিল্প শহর, যে শহরতলী একসময় ছিল রাজ্যের শিল্প মানচিত্রের পীঠস্থান আজ সেই অঞ্চল যেন মৃতনগরীতে পরিনত হয়েছে। তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে গেল দুর্গাপুরের ঐতিহ্যের শিল্প বুনিয়াদ।

তবে ছোটো থেকেই আমার দাদামশাই এর আদর্শকে দেখে বড়ো হয়েছি তাই এই দিনগুলোর একটা গুরুত্ব আছে আমার কাছে। আমার দাদামশাই (প্রয়াত সুধীর কুমার চক্রবর্তী) তিনি নেতাজীর আদর্শকে নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ চলা শুরু করেছিলেন। ওনার সংগ্রহে নেতাজীর কাছ থেকে পাওয়া 'উত্তরীয়', কানাইলাল ভট্টাচার্যের কাছ থেকে পাওয়া তৎকালীন 'ভারতের ইতিহাস' বইটি এখনও স্বযত্নে রাখা আছে, এছাড়াও সেই সময়কার বেশ কিছু পত্রিকা, সংবাদপত্র আজও স্বযত্নে রাখা আছে।

দাদামশাই বাড়ীতে নিজেই পতাকা উত্তোলন করতেন, ঐ অঞ্চলের মানুষেরা ওনাকে "ভূমিপুত্র" বলেই চেনেন ও জানেন। তবে দাদামশাই আমৃত্যু একটাই দুঃখ করে গেলেন (নেতাজীর মতাদর্শের মানুষ) "এই তিনটুকরো স্বাধীনতা আমরা চাইনি"।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে যখন কমিউনিস্টরা বলত "এ আজাদী ঝুটা হ্যায়", আমার দাদামশাই এই স্লোগানটাকে পছন্দ করলেও তাদের মতাদর্শেকে মানতে পারননি।

আবার স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশে (কেন্দ্রে) ও রাজ্যে কংগ্রেস রাজত্ব করলেও তিনি তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শকে খুব ভালোভাবে মেনে নিতে পারতেন না তবে বিধানচন্দ্র রায়কে দাদামশাই খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং বলতেন "এনাদের মতো মানুষের বড়ো অভাব আমাদের দেশে"।

আজ আমরা ৭২ তম গণতন্ত্র/ প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করছি কিন্তু নিজের মনকে একটু প্রশ্ন করে দেখুন তো আমরা সত্যিই কি নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক দেশে বসবাস করি বলে মনে হয়? প্রশ্ন জাগে না আপনাদের মনে? আমাদের মতো মানুষের মতামতের কোনো দাম আছে এদেশে?                   

আমরা শুধু ভোটের বালাই, ভোট আসলেই আমাদের ডাক পড়ে আর আমরাও অবাক জলপানের মতো ভোটের লাইনে দাঁড়াই।

UPA জোট সরকার, NDA কেউ কি আমাদের কথা ভাবেন? ব্যাঙ্কের সুদ দিন দিন কমতে থাকছে, ভাবতে পারেন যারা MIS ভুক্ত মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ কী?

ভারতবর্ষে এই ৭২টি প্রজাতন্ত্র দিবসের মধ্যেই সমগ্র দেশে ১২০টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। 

বর্তমান মোদী সরকার কেন্দ্রের গদীতে বসেই রাতারাতি নোটবন্দী করলেন, কি জন্য? নাকি বিদেশ থেকে কালো টাকা ফেরৎ আনা হবে। আদৌ কি কলো টাকা ফেরৎ এলো? উল্টে নোটবন্দীর জন্য ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে  কতগুলো প্রাণ ঝড়ে গেলো। 

বলতে পারেন আমাদের এই প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোন সরকারি চাকরির আশা-ভরসায় থাকবে? এই ৭২ তম প্রজাতন্ত্র দিবসের গর্ভে আজও আমাদের একাংশ দেশবাসী নিরন্ন অবস্থায় মারা যান। চিকিৎসার অভাবে প্রান হারান। কত গঞ্জে আজও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। শিক্ষা আজও তো অধরাই থেকে গেল আসমুদ্রহিমালয়ের কোনে কোনে। দেশটা কি আবার বিদেশের হাতে কেনাবেচা চলছে? এটা আমাদের সংশয়।

আজকাল তো আবার চারিদিকে গুঞ্জন, একটাই রব একটাই শব্দ NRC, জানিনা---এর শুরু বা শেষ কোথায়? কোনটা ঠিক কোনটা ভুল? এদেশের নাগরিকই বা কে? আর অনুপ্রবেশকারীই বা কে?

বর্তমানে "জয় শ্রীরাম" নিয়ে মাতামাতি চলছে, যেন মনে হচ্ছে ভগবান শ্রীরাম জন্মেই বোধহয় 'ভারতীয় জনতা পার্টি' উদ্ভাবন করেছিলেন আর তাই "জয় শ্রীরাম" শুধু ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যদের 'রাম' নেই।

আবার নেতাজীকে নিয়ে যে BJP, RSS এত মাতামাতি করছেন কিন্তু কতজন মানুষ প্রকৃতপক্ষে জানেন যে সেই সময়কার ওনাদের বিশেষ কিছু নেতা মানুষ ব্রিটিশের ধ্বজাধারী ছিলেন এবং নেতাজী তাদের বিরোধীতা করেছিলেন।

আজও আপামর বাঙালী তথা ভারতবাসীর মনে প্রশ্ন জাগে নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্যে কাদের সহযোগীতা ছিল, একথা কে বলত পারবে? আমাদের মতো অতি সাধারণ মানুষ এইটুকুই ভাবতে পারি যাদের স্বাধীন দেশের গদীর লোভ ছিল তারাই এই অন্তর্ধান রহস্য জানেন।

যাইহোক আজ ৭২ তম গণতন্ত্র/প্রজাতন্ত্র দিবসে একটাই শপথ নেওয়ার দিন আগামী দিনগুলো নেতাজীর মতাদর্শে চলতে পারলে হয়তো স্বাধীন ভারতবর্ষের মানুষগুলো স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করতে পারবে।

জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম।

(www.theoffnews.com - Indian Republic Day)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours