সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর, হুগলি: 

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের হাওয়ায় হিন্দিভাষী চতুর রাজনীতিকরা বাংলার সংস্কৃতির পোষাক পরে মাঠে নেমে পড়েছে। বিজেপি-র বাংলার মনীষিদের সাথে একাত্ম হতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান হয়ে গিয়েছে শান্তিনিকেতন। বীরশা মুন্ডার মুর্তির গলার মালা উঠেছে এক আদিবাসী শিকারী মূর্তির গলায়। পাশপাশি বিবেকানন্দের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। চৈতন্য  মহাপ্রভুর দীক্ষাস্থান গুলিয়ে দিয়েছে স্বয়ং বিজেপির সভাপতি জে পি নাড্ডা। গোবলয়ের নেতাদের  ভুল বাংলা উচ্চারণের প্রতিযোগিতা চলছে কেবলমাত্র বাংলার আত্মাকে কব্জা করার জন্য। রবীন্দ্রনাথের কবিতার অর্ধ বিকৃত উচ্চারণে অর্থ যাচ্ছে পাল্টে। ভাইপো যেখানে ‘ভাতিজা’। আরও ভয়ংকর কথা ছবিতে কবিগুরুকে গুজরাট দাঙ্গায় মদতকারী অমিত শাহ-এর পায়ের নিচে স্থান দেওয়া হয়েছে।

অমিত শাহ-এর ভাষায় ‘বংগাল’ দখল করতে এসে বিজেপি-র ভৈরব বাহিনী ক্রমশ তাদের দাঁত নখ বার করে ফেলছে। সাথে সাথে আস্ফালন বেড়েছে তৃণমূল থকে দলত্যাগী সারদা কেলেংকারীতে জড়িত দুর্নীতিপরায়ন নেতাদের সাথে নিয়ে। সেই কারনে বংগালকে ভবিষ্যত ‘সোনার বাংলা’ বানানোর পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমেই মনে আসে প্রধানমন্ত্রীর সাধের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যটির ভয়ংকর অধোগতির কথা। সংখ্যালঘু নিগ্রহের ঘটনায় যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য সারা দেশে অগ্রগণ্য। মহিলাদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় উত্তরপ্রদেশ দেশের সর্বোচ্চ স্থানে। তফসিলী জাতিভুক্ত মানুষের উপর অত্যাচারেও উত্তরপ্রদেশ এক নম্বরে। সেখানে প্রতিবাদী সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, ডাক্তার, সাধারন মানুষ প্রত্যেকেই সরকারের বিরূদ্ধে মুখ খুললেই মিথ্যা মামলায় হাজতবাস। মোদীর রাজত্বে যারাই প্রতিবাদী কন্ঠস্বরে মুখর হয়েছেন তাঁদেরই তকমা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রদোহিতার। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, দিল্লীতে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে কৃষকদের একমাসেরও অধিক অবস্থান। শিশু, মহিলা, বৃদ্ধদের সাথে সকল কৃষকদের বানিয়ে দেওয়া হল মাওবাদী ও খালীস্থানী জঙ্গি হিসাবে। এই রাজ্যে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেনকে স্বর্ণকার মাননীয় দিলীপ ঘোষ ‘জমি চোর’ বলে বিবৃতি দিয়ে বসলেন। সম্প্রতি অভিনেত্রী সায়নী ঘোষকে প্রতিবাদের জন্য বঙ্গ বিজেপির সুসন্তানেরা  ধর্ষনের  হুমকি  দিয়েছে। কোন প্রতিবাদ বিজেপির নেতাদের তরফে করা হয়নি বরং এতে ইন্ধন যোগান হয়েছে। এই ক্ষেত্রে  আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কেন না বিজেপির ধর্মগুরু হিন্দু মহাসভার নেতা ভি ডি সাভারকর তাঁর রচিত ‘সিক্স গ্লোরিয়াস ইপকস অব ইন্ডিয়ান  হিস্ট্রি’ বইটিতে ছত্রপতি শিবাজী ও চিমাজী আপ্পাকে ধিক্কার জানিয়েছেন। তার কারণ, তাঁরা যথাক্রমে কল্যানের মুসলিম রাজ্যপাল এবং বাসেইনের পর্তুগিজ রাজ্য প্রধানের স্ত্রীদের বন্দী করেও ধর্ষণ না করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই সূত্রধরে এই সময়ে এসে বর্তমান চেলারা আর ভুল করতে রাজী নয়। সেইকারনে অভিনেত্রীর প্রতি এই নিদান।

অন্যদিকে দেশের বয়স্ক মানুষদের প্রতিবাদী  বক্তব্যও এই মনুবাদী দলটি মেনে নিতে রাজী নয়।২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রের ভীমা-কোরেগাঁওয়ে জাতিহিংসার যে ঘটনা ঘটেছিল তাতে ৮০ বছরের অসুস্থ কবি ভারাভারা রাও, আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ প্রমুখ বিশিষ্ট সমাজ আন্দোলনকারীরা মিথ্যা অভিযোগে এক বৎসরের উপর কারারুদ্ধ রয়েছেন। বহু বছর ধরে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় ও কল্যাণের সাথে জড়িত ৮৩ বছরের পাদ্রি স্ট্যান স্বামীকে সরকারের বিরোধীতার কারনে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। আশ্চর্য জনকভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে কোন নির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমান দাখিল হয়নি আদালতে। এ এক অলিখিত জরুরী অবস্থা। ব্যক্তির কন্ঠরোধের চেষ্টা।

আসলে ইংরেজদের পদলেহনকারী আরএসএস দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনদিনই অংশগ্রহণ করেনি। দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা সাভারকরের হাত ধরে আরএসএস হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ নির্বিশেষে  ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে ভারতবর্ষকে কোন কালেই দেখতে চায়নি। ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, “সাম্প্রদায়িক পথে ভারত বিভাগের ধারণাটির উদ্ভাবনের জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী হল হিন্দু  মহাসভা”। আন্দামান জেলে বন্দিদশার সময় রাজসাক্ষী হিসাবে নিজেকে দাঁড় করিয়ে ক্ষমাপ্রার্থী  সাভারকর বিপ্লবীদের গুপ্তকথা ফাঁস করে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকে পিছন থেকে কার্যত ছুরি মেরে ছিলেন। তাঁর উত্তরসূরি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়েরও রাজনৈতিক শঠতার ক্ষেত্রে জুড়িমেলা ভার। বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইরন উইনার বলেছিলেন- “শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন আপাদমস্তক একজন চতুর ও সুযোগসন্ধানী এক রাজনীতিক। তাঁর কাছে কোন আদর্শবাদ নয়, বরং ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতার ভর কেন্দ্রে থাকাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। যখন যেখানে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন, তিনি সেখানেই ছুটে গেছেন”। তাঁর রাজনৈতিক গুরু সাভারকরের মতই শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন ইংরেজদের পদলেহনকারী। ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে শ্যামাপ্রসাদ উচ্ছৃঙ্খলতা আখ্যা দিয়ে বৃটিশদের বলেছিলেন- ‘আমি মনে করি না, গত তিন মাসের মধ্যে যেসব অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা ও নাশকতামূলক কাজ করা হয়েছে, তার দ্বারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের সহায়তা হবে’। ১৯২১-২২ –এর অসহযোগ আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনা ও অফিসারদের বিচারের বিরূদ্ধে আন্দোলন, ১৯৪৬-এর নৌ বিদ্রোহ এবং ওই বছরের ২৯ জুলাই  দেশব্যাপী ধর্মঘট – এসবে শ্যামাপ্রসাদের নিষ্ক্রিয় ভুমিকা বৃটিশদের খুশী  করেছিল। বাংলা ভাগের স্রষ্টা শ্যামাপ্রসাদের বিখ্যাত উক্তি ‘ভারত ভাগ হোক বা না হোক  বাংলাকে ভাগ করতেই হবে’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইংরেজদের পক্ষে পূর্নসমর্থনকারী এই খলনায়ক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে কুচকাওয়াজের সময় শ্যামাপ্রসাদ ছাত্রদের হুকুম করেন বৃটিশদের পতাকাকে অভিবাদন করতে হবে। ছাত্ররা প্রতিবাদ জানালে শ্যামাপ্রসাদ তাদেরকে চাবুক মারার হুকুম দেন। বিক্ষোভ দেখালে শ্যামাপ্রসাদ দুজন ছাত্র নেতা ধরিত্রী গাঙ্গুলী ও উমাপদ মজুমদারকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেন। পরবর্তী সময়ে ছাত্র আন্দোলনের চাপে সিণ্ডিকেট তাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন (আন্দবাজার পত্রিকা -১৪মে, ১৯৪০)। বাংলাভাগের ক্ষমতালিপ্সু নেতা সেই শ্যামাপ্রসাদের হাতে গড়া বর্তমান উচ্ছৃঙ্খল বাহিনী মানুষের ঘরে ঢুকে দেখছে তারা কি খেয়েছে, কি উৎসব পালন করছে? আজকে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ তাদের রাজনৈতিক ইস্তাহারের অঙ্গ। বর্তমানে বিজেপি-র ‘লাভ জেহাদের’ রাজনীতি, ক্ষমতা উন্মাদের গৈরিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকৃত আস্ফালন। ব্যক্তি পরিসরকে ধর্মীয় রাজনীতির আখড়া বানানোর কৌশল তাদের জন্মলগ্ন থেকেই।

নাগরিকত্ব আইন, রাম মন্দির আর আদানিদের হাতে রেল, বিমান বন্দর, কৃষিজাত উৎপাদন তুলে দেওয়া ছাড়া বিগত বছরগুলিতে মোদী সরকারের আর কোন কৃতিত্ব নেই। পুলয়ামা কাণ্ডে ৪০ জন সেনার মৃতদেহের বিনিময়ে শ্রী নরেন্দ্র দামোদাস মোদী গট আপ খেলায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছিলেন। রিপাবলিক টিভি-র অর্ণব গোস্বামীর সাথে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গোপনীয়তাকে মোদীজি সকলের সামনে উন্মোচন করে দিয়েছেন। তাই ভাবতে হবে কুসংস্কারছন্ন ,অবৈজ্ঞানিক ও মধ্যযুগীয় মনোভাবাপন্ন বিজেপি-র নেতাদের হাতে এই রাজ্য কতটা সুরক্ষিত থাকবে? আজকে বিজেপি-র নেতারা সুভাষচন্দ্রের সাথে শ্যামাপ্রসাদকে একই আসনে বসানোর অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই শ্যামাপ্রসাদ ’৪৩-এর ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের সময় নিজের প্রভাব খাটিয়ে হুগলীর জিরাটে যে প্রাসাদোপম অট্টালিকা তৈরী করেছিলেন তা নিয়ে ঐ সময় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। শ্যামাপ্রসাদ -এর সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ব রাজনীতির তীব্র বিরোধী  ছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র। ১২ মে ১৯৪০-এ নেতাজী ঝাড়গ্রামের জনসভায় বলেছিলেন- ‘হিন্দুমহাসভা ত্রিশূলধারী সন্ন্যাসীদের কাজে লাগাচ্ছে রাজনীতিতে জায়গা তৈরীর জন্য। হিন্দু ধর্মকে কাজে লাগিয়ে গৈরিক বসনের ভেকধারীদের দিয়ে, এরা ভোট চাইছে। কিন্তু তা করে এরা শুধু হিন্দু ধর্মের অপমানই করছে না, তাকে অপবিত্রও করছে। সুতরাং, এইরূপ দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক তথা ধর্মদ্রোহী হিন্দুমহাসভা এবং হিন্দুত্ববাদীদের সমাজের থেকে বর্জন করা সকল হিন্দুর কর্তব্য’।  পরবর্তীকালে শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ডায়েরীতে লিখেছেন- ‘সুভাষচন্দ্র আমার সাথে দেখা করেন এবং বলেন, হিন্দু মহাসভা যদি বাংলায় রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে মাথাচাড়া দিতে চায় তবে সেটা জন্মের আগেই গুঁড়িয়ে দিতে বাধ্য হব, যদি বল প্রয়োগ করতে হয় তাহলে সেটাই করব’। আজকে সুভাষচন্দ্রের এই চিন্তাধারাকেই মর্যাদা দিতে হবে।  বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে হিন্দিভাষীদের কবল  থেকে মুক্ত করাই আজকে প্রথম ও একমাত্র চ্যালেঞ্জ। বাংলাকে সাম্প্রদায়িক রক্তে রাঙা মুখোশধারীদের করাল গ্রাস থেকে বাঁচাতে হবে।  সুতরাং সাধু সাবধান!

(www.theoffnees.com - Bengal politics BJP RSS Netaji Shyamaprasad)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours