মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

পুরুষতন্ত্র কথাটি আগেও ছিল। এই আধুনিক সভ্যতায়ও আছে। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে মেয়েদের অবস্থান আগের থেকে বদলালেও খুব একটা অগ্ৰসর হতে পারেনি।নারীবাদীরা এরজন্য সবসময় পুরুষদের দায়ী করে এসেছেন। কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হেনস্থা থেকে শুরু করে সমাজে নারীদের অসম্মানের দায়টা সবসময়ই পুরুষদের ওপর বর্তায় এবং সেটা অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু সমস্যার গভীরে গিয়ে ভাবলে একটা অন্য সত্য ধরা পড়ে। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজকে টিকিয়ে রাখার মুল কান্ডারী কিন্তু নারীরা স্বয়ং।

সংসারে বৌমার প্রতি শাশুড়ির অসূয়া থেকে যে অত্যাচারের সৃষ্টি তা সেখানে পুরুষের ভূমিকা কোথায়? বৌমার পোশাক থেকে শুরু করে কথা বলা, হাঁটাচলা এমনকি সে কতটা সময় স্বামীর সঙ্গে কাটাবে, একসাথে বেড়াতে যাবে কিনা সব নিয়ন্ত্রিত হয় শাশুড়ির দ্বারা। ননদ তাতে ঘৃতাহুতি দেয়। ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গেলে ছেলের মায়ের প্রথম কথা "আমরা ঘরোয়া মেয়ে চাই।" চাকরি করা বৌমাকে পদে পদে হেনস্থা হতে হয় শাশুড়ি ননদের হাতে।অহরহ ছেলের কানে বৌমার বিরুদ্ধে মন্ত্রণা দেওয়া হয়।ফলস্বরূপ ছেলেটি বৌয়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য হয়।প্রতিবাদ করলে বৌটির কপালে জোটে নানাবিধ শাস্তি।তাই কেউ সংসার ছাড়ে, কেউ বাধ্য হয় চাকরি ছেড়ে সংসারে শান্তি বজায় রাখতে। আবার কেউ মৃত্যুর মধ্যে শান্তি খুঁজে পায়।

এখানেই চরম মেধাবী মেয়েটি হেরে যায় পুরুষতন্ত্রের কাছে। অথচ এই পুরো ব্যাপারটায় ছেলেদের কোন হাত নেই কিন্তু।প্রতক্ষ‍্য এবং পরোক্ষভাবে মেয়েরাই পুরোটা নিয়ন্ত্রন করে। 

বিপরীতে আমরা দেখি দজ্জাল বৌয়ের উসকানিতে বিবাহিত ছেলেটি তার মা বাবাকে ত্যাগ করে, অথবা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়।

পাঁচ বাড়ি কাজ করে সংসার চালানো  মেয়েটি মুখ বুজে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করছে কারন স্বামী দেবতা। সেই মেয়েটিও কিন্তু পুরুষতন্ত্রকেই বহন করে চলেছে। 

স্ত্রীর ব্যবসায় সাহায্যকারী পুরুষ বা রান্নাঘরে বৌকে সাহায্যকারী ছেলেটিকে তারই মা বা মহিলা আত্মীয়দের কাছে এমন গঞ্জনা শুনতে হয় যে সে লজ্জাবোধ করে। এগুলো সবই পুরুষতন্ত্রকে বয়ে নিয়ে চলে প্রজন্মের পর প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

এ যেন এক চক্র। শেষ নেই। 

ডিভোর্সী মেয়েকে এ সমাজের মাসীমা কাকীমারাই নানাবিধ কটুক্তি কটাক্ষ করেন।রাত বিরেতে কাজ সেরে ফেরা মেয়েটি অথবা মর্ডান পোশাকে সজ্জিত কিশোরীকে নিয়ে মেয়েমহলের মুখোরোচক গসিপ পাড়ার তথাকথিত ভদ্রমহিলাদের মাথা ও মন ঠাণ্ডা রাখে। এই সব কাকীমা, জেঠিমারা কিছুতেই মানতে পারে না যে ছেলেদের কোন দোষ হয়। তাঁদের মতে ধর্ষন থেকে মাণসিক অত্যাচার সব কিছুর জন্য মেয়েরা নিজেরাই দায়ী। 

এখানে পুরুষদের ভূমিকা নগন্য। কন্যা ভ্রুণ হত্যার ক্ষেত্রেও শাশুড়ির ভূমিকা অনস্বীকার্য। বংশরক্ষার তাগিদে নাতি চাই আব্দার, অথবা সন্তানহীনতার জন্য কেবলমাত্র ছেলের বৌকে দায়ী করা শাশুড়ি আজও প্রবলভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাহক। কার মেয়ে কালো, কার মেয়ে পড়তে গিয়ে ঢলাঢলি করে এসব গসিপ মেয়েদের মধ্যেই বেশী হয়। আবার কোন মেয়ে কর্মক্ষেত্রে, সাহিত্য জগতে বা অন্য কোন জায়গায়  উন্নতি করলে, নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করলে তার বান্ধবীটি জ্বলে পুড়ে মরে।একজন মহিলা ও পুরুষের নির্মল বন্ধুত্ত্ব অশালীন ঠেকে সমাজের একশ্রেণীর মহিলাদের চোখে। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারিত মেয়েকে তার মা প্রতিবাদের বদলে মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা দেয়।এভাবেই পুরুষ তন্ত্র তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে চলেছে।

একসাথে ওঠাবসা করা তিনটি পুরুষ নানাবিধ আড্ডায় মেতে উঠলেও একসাথে দুটি মহিলা পরনিন্দা পরচর্চা ছাড়া থাকতেই পারে না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লেখিকার বা মহিলার ব্যক্তিজীবনের পরকীয়া নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নোংরা ঘাঁটেন অপর একদল মহিলাই।

তবে খুশির বিষয় এই যে বিদূষী মহিলারা এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম কিন্তু তাঁরা মুষ্টিমেয়।

মেয়েরা যৌন হেনস্থার শিকার হয় পুরুষদের কাছে, তা নিন্দনীয়। কিন্তু যেসব মেয়েরা নিজের শরীরকে উন্নতির সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে তারা সমান ভাবে নিন্দনীয় নয়? নারীর আত্মসন্মানকে তারা প্রতি মুহুর্তে ধর্ষণ করে।

মহিলা সমিতিতে নারীকল্যাণ নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া নারী নিজের বাড়িতে শিশু পরিচারিকাকে অত্যাচার করে। নিজের ছেলের সমস্ত নোংরামি ঢেকে দেওয়া সেলেব্রিটি মা বা এই ধরনের মহিলারা আজও পুরুষ তন্ত্রের একনিষ্ঠ বাহক হয়ে সগর্বে সমাজে চলাফেরা করেন।

সমাজে নারী ও পুরুষের সুস্থ সহাবস্থানের ফলেই এক সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠে। এর কোন একটাকে বাদ দিলেই সমাজের ক্ষয়।অন্তর্বাস পুড়িয়ে , ছোট পোশাক পরে নারীবাদী হওয়ার বদলে মুক্তমনা মানুষ হলেই প্রকৃতপক্ষে নারীর জয় হবে। আজ সমস্ত নারীরা যদি হিংসা ইগো ভুলে একে অপরের সমর্থনে দাঁড়ায় তবেই পুরুষতন্ত্র অবলুপ্ত হবে।

(www.theoffnews.com - men women dominating)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. বুদ্ধির গভীরে সুন্দর ব্যাখ্যা।সঠিক দৃষ্টি সঠিক চিন্তা।উপযুক্ত কথা,নুতন নয় তবু নতুন ভাবে উপস্থাপন।ধন্যবাদ আর আশীর্বাদ।

    ReplyDelete