পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

শান্তিপুরের কারিগর পাড়ার বুঁচকি পিসির টিভির সঙ্গে বেজায় দোস্তি  ছিল। এদিক ওদিক ঘুরিয়ে গন্ডা খানেক সিরিয়াল তো আছেই, সেই সঙ্গে উত্তম সুচিত্রার বই হলে তো কথাই নেই। কেবল্‌ লাইনের পল্টু এসে মাসে মাসে সত্তর টাকা করে নিয়ে যেত। বিধবা ভাতা থেকে বাঁচিয়ে বুঁচকি পিসি সত্তর টাকা তাই আগে ভাগেই তুলে রাখতেন। বছর খানেক আগে হঠাৎ অসময়ে পল্টু এসে হাজির। কি একটা কাগজ হাতে এসে বলল “বল পিসি, কি কি দেখপা?” সে আবার কি? বুঁচকি পিসি তো বেশ চাপে। এটা দেখি, ওটা দ্যাখপো, ওটা ভাল লাগে, এইটা তো চাইই, এইসব করে শেষমেশ একটা লিস্টি খাড়া করা হল। এবার পল্টু মাথা টাথা চুলকে, হেব্বি টিসেব টিসেব করে জানাল তোমার হয়েছে তিনশো পাঁচ টাকা। বুঁচকি পিসি হাঁ, পল্টু বোঝালো “সরকার বলেছে যে টুকু দেখপা সেটুকুরই দাম দেবা।” তাই এখন যেটা সত্তর, কেন্দ্রীয় সরকারী বিচক্ষণতা এবং জনদরদি চিন্তায় সেটাই দাঁড়িয়েছে তিনশো টাকায়। এর কমেও হবে, দু একটা অচল পয়সার মত চ্যানেল পাওয়া যাবে তাও দেড়শোরও বেশি টাকায়। সত্তর টাকার গল্প শেষ। বুঁচকি পিসির টিভি দেখার সাধও শেষ। এই একই গল্পে মিলেমিশে একাকার শান্তিপুরের বুঁচকি পিসির সঙ্গে গঙ্গারামপুরের নিত্যানন্দ মেসো বা শালতোড়ার সুহাসিনী হাঁসদা। 

শহর ছাড়িয়ে সেই কবেই গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে গেছে কেবল টিভি। ধনী  গরিব নির্বিশেষে এখন ঘরে ঘরে কেবল টিভির একছত্র বিস্তার। খুব বড় শহর বাদ দিলে ছোট শহর, মফঃস্বল, গ্রাম গঞ্জ প্রায় সব জায়গাতেই কেবল লাইনের জন্য কম বেশি একশো থেকে দেড়শো টাকা দিতে হত পরিবার পিছু। বিনিময়ে মিলত প্রায় ছশো থেকে সাতশো চ্যানেল। না, সব কটা ভাষার সব কটা চ্যানেল কেউ দেখতেন এ দাবী এখনও কেউ করেননি। কিন্তু ওই টাকায় পাওয়া যেত সবই। জনদরদি সরকার, এবং আরও দরদি এবং জনহিতকারী সরকারী সংস্থা ট্রাই হিসেব কষল মানুষের এতে নাকি দারুণ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। তাই তারা বলল এত চ্যানেল কেউ দেখেন না তাই দাম দেওয়ার দরকার নেই। এ গল্প সকলেরই জানা। ট্রাই সাধারণ মানুষের কথা ভেবে দর বেঁধে দিল ১৩০ টাকা। সঙ্গে ১৮ শতাংশ জিএসটি দিয়ে প্রায় ১৫৪ টাকা। সর্বনিম্ন দর। অর্থাৎ আগের দর অধিকাংশ জায়গাতেই ট্রাইয়ের ন্যুনতম দরের চেয়ে কম ছিল। এবারে ট্রাই জানাল ১৫৪ টাকায় মিলবে ফ্রি চ্যানেল। অর্থাৎ আমরা সাধারণত যে চ্যানেলগুলি দেখে থাকি তার সিংহ ভাগই ওই টাকায় মিলবে না। বাংলা বা হিন্দি সিরিয়াল, সিনেমা, খেলা ইত্যাদির চ্যানেল দেখতে গেলে কম পক্ষে দুশো টাকা থেকে তিনশো টাকা দিতেই হবে। 

এখানেই শেষ নয়, ট্রাই আসার পর মোবাইলের খরচও বেড়েছে বহুগুণ। ট্রাইয়ের বদান্যতায় সব মোবাইল কোম্পানিরই এখন বছরের সব মাসই ফেব্রুয়ারি। আচ্ছা ফেব্রুয়ারি ছাড়া আটাশ দিনে আর কোনও মাসের কথা আর কেউ জানেন কি? কিন্তু ট্রাই জানে। তাই তাদের প্রত্যক্ষ সম্মতিতে এখন মোবাইল কোম্পানিরা আটাশ দিন অন্তর মাসিক রিচার্জের সময় বেঁধে দিয়েছে। অর্থাৎ আপনার আমার কাছ থেকে ১২ মাসে ১৩ মাসের টাকা নিয়ে নেওয়া হচ্ছে সরাসরি। প্যাকেজের মূল্যেরও মা বাপ নেই, আগে একবার রিচার্জ করলে মাস ছয়েক কথা বলাই যেত ব্যালান্স থাকলে। এখন মাসে, থুড়ি আটাশ দিনে একবার রিচার্জ করতেই হবে।   

সহজেই অনুমেয়, ট্রাই বা সরকার আমাদের(পড়ুন সাধারণ মানুষের) কথা কতটা ভাবে। আমাদের উপকারের কথা ভেবে ঘুম হচ্ছে না সরকারের। রাতের পর রাত জেগে জনহিতকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বুঁচকি পিসির সত্তর টাকার চ্যানেল তিনশো টাকায় পৌঁছে দিয়েছে সরকার। না আমি কোনও রঙের কথা বলছি না। একজন সাংবাদিক অথবা সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখেছি সরকারে গেলে সকলেই সমান। তাই বুঁচকি পিসিদের হয়ে গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করে ‘দয়া কর ওগো সরকার, আমাদের কোনও উপকারের নেই দরকার’।

(www.theoffnews.com - tri telecom)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours