পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

শীতের বিকেল, আরামবাগের কাছে কালীতলা মোড়ে চা খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছি। সামনেই চলছে বিজেপির পথসভা। ভুল উচ্চারণে, ভুল তথ্য দিয়ে, উচ্চস্বরে একটি ভুলে ভরা ভাষণ দিচ্ছেন স্থানীয় কোনও বিজেপি নেত্রী। আগের দিনই তৃণমূল থেকে শুভেন্দু অধিকারী সহ এক ঝাঁক নেতা নেত্রী যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। চাঙ্গা বিজেপির অতি উৎসাহী নেত্রী তাই কৃষি বিলের উপকারিতা বোঝাচ্ছেন সকলকে। সামনে কয়েকশো মানুষ তা গিলছে। পুরুলিয়া থেকে কলকাতায় ফিরবার পথে এমন সভা চোখে পড়েছে বেশ কয়েকটা। পাল্টা কিছু মিছিল বা সভা তৃণমূলও করছে বটে, কিন্তু তাতে সেই আগ্রাসী মনোভাবের অভাব চোখে পড়ল। কোথাও যেন আত্মবিশ্বাসে সামান্য চিড় ধরেছে কি? 

গ্রামে গঞ্জে ঘোরাঘুরির সূত্রে দেখছি সাধারণ মানুষ স্পষ্টতই দ্বিধা বিভক্ত। তৃণমূলের নির্বুদ্ধিতার সুযোগে গ্রামে গঞ্জে জাঁকিয়ে বসেছে বিজেপি। তৃনমুলের একটা পতাকা থাকলে পাশে বিজেপির তিনটে পতাকা নজরে আসছে। ক্রমশ ভিড় বাড়ছে বিজেপির মিছিলে, সভাতে। তৃণমূল বিদ্বেষে অন্ধ মানুষজন জাটিঙ্গা পাখির মত ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিজেপির আগুনে। কেন্দ্রে সরকারে থেকে বিজেপি সাধারণ মানুষকে একের পর এক ভোগান্তি উপহার দিয়েছে। তাদের নানান অ-জনহিতকারী সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত, বিপন্ন। কিন্তু বাংলাতেও স্থানীয় তৃণমূল নেতা কর্মীদের আচার ব্যবহার অত্যাচারে তিতি বিরক্ত সকলেই কিছু একটা বিকল্প খুঁজে চলেছেন। এই বিকল্প খোঁজার রাস্তাতেই বিজেপি সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু একটু বুদ্ধিসুদ্ধি যাদের আছে তারাই পড়েছেন দোটানায়। বলা ভাল তিনটানায়।

বিজেপি এখন যেমন আগ্রাসী তাতে তারা পারলে বোধহয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তৃণমূল থেকে ভাঙিয়ে নিয়ে নেয়। ছোট বড় মেজ সেজ, যে কোনও নেতা কর্মী পেলেই তাকে দলে নিয়ে নিচ্ছে বিজেপি। ভাল – মন্দ, দূর্নীতির ছাপ, অপরাধীর তকমা কোনও কিছুরই তোয়াক্কা বিজেপি নেতৃত্ব করছে না, দলভারি করবার তাড়নায়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই পুরনো বিজেপি কর্মীরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অন্য দলের যে নেতার বিরুদ্ধে এতদিন দুর্নীতি, অকাজের কথা বলে এসেছেন আজ সেই নেতাই তাদের মাথার উপরে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই গায়ে লাগছে তাদের। একটু মনে করুন এগারোতে জিতে আসার ঠিক আগে এবং পরে তৃণমূলও একই কাজ করেছিল। অন্যের দল ভাঙিয়ে সিপিএম, কংগ্রেস নির্দল সহ যাকে পেরেছে দলে টেনে এনেছিল। তখন সেই দলবদলের কারিগর মুকুল ছিলেন দুটি ফুলে, এখন সেই মুকুলই একটি ফুলে। 

এতেই বিভ্রান্ত সাধারণ মানুষ, এতেই বিরক্ত পুরনো বিজেপি কর্মীরা। ক্ষমতার আশায়, পাওয়ার সুবিধার জন্য দল পাল্টানো রাজনীতিতে খুব সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু টকের জ্বালায় পালিয়ে গিয়ে যদি তেঁতুলতলাতেই ফের বাস করতে হয় তবে লাভ কি? এই প্রশ্নই ঘুরছে বাংলার আনাচে কানাচে। যে তৃণমূল নেতাদের অত্যাচারে বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন সাধারণ মানুষজন, সেই তৃণমূল নেতাদের ভিড়েই এখন নাভিশ্বাস পুরনো বিজেপির।বিজেপিকে এখন অনেকেই তাই বিজেমূল বলে ডাকছেন। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্টের মত বিজেমূলটা বাজে মূল হওয়ার আশঙ্কা করছেন সিংহ ভাগ মানুষজন।   

এদিকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পণ করেছেন তৃণমূল থেকে নেতা কর্মী ভাঙিয়ে এনেই দল ভরাবেন। আসলে এতগুলি বছরে তারা নিজেদের কোনও মুখ তুলে ধরতে অসফল। এমন কেউ এখনও বঙ্গ বিজেপিতে নেই যিনি ডাকলে মাঠ ভরাবে সাধারণ কর্মীরা। তাই অন্যের ঘর থেকে নেতা চুরি করে এনে নিজেদের দোষ বা অক্ষমতা ঢাকার অপচেষ্টা। এতে হয়তো চমক দিয়ে ক্ষমতায় আসা যেতেও পারে, কিন্তু টিকে থাকা মুশকিল। কারন আজ যারা দল বদলে দুই ফুল থেকে এক ফুলে মধু খেতে গিয়েছেন, তারাই হয় তো আগামীতে অন্য কোনও ফুলে ভ্রমর হয়ে উড়ে যাবেন। আগে কোনও দলে আদর্শ মেনে কর্মীরা থাকতেন, এখন সুখ সুবিধা জেনে কর্মীরা থাকেন। তাই নব্য বিজেমূল বাংলাকে কতটা সুখ সুবিধা দিতে পারে তা আগে থেকেই সম্যক বুঝতে পারছেন সামান্য রাজনৈতিক জ্ঞান থাকা ব্যক্তিরাও। আসন্ন নির্বাচনে সিপিএম বা কংগ্রেস, জোট করুক বা না করুক বাংলায় কিছু করতে পারবে, এমনটা অলীক স্বপ্ন কেউই দেখছেন না। তাই তৃণমূল না কি বিজেমূল? আপাতত ধন্দে বাংলার অসহায় মানুষজন।

(www.theoffnews.com West Bengal politics CPM BJP TMC Congress)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours