ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ নেই, এমন মানুষ বিরল। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রতি ভালবাসা এবং চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর অনুদান প্রদান করে থাকে। আমরা সকলেই জানি, বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিবান্ধব ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপস কর্পোরেশন বা বিএফডিসি নির্মান করা হয়েছে। এই বিএফডিসিকে বলা হয় এ দেশের চলচ্চিত্রের সুতিকাগার। ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের হাত ধরে এদেশে নির্মিত হয়েছে একের পর এক বিখ্যাত, কালজয়ী চলচ্চিত্র। আর এভাবেই দেশ বিদেশে বাংলা চলচ্চিত্রের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা চলচ্চিত্রকে পৃষ্ঠপোষক করতে সরকারী অনুদানের ব্যবস্থা করা হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে নিয়মিত চলচ্চিত্রে অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে এই অনুদানের পরিমান করা হয়েছে পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য ৭৫ লাখ এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য ২০ লাখ টাকা। 

চলচ্চিত্রের অনুদানের জন্য আবেদন করার সময় গল্প, চিত্রনাট্য, দৃশ্যধারণের বিশদ বিবরণ প্রদান করতে হয়। অনুদানে প্রাপ্য টাকার সার্বিক খরচের হিসাব প্রদান করতে হয়। এরপর অনুদান কমিটি যাচাই বাছাই করার পর অনুদানের জন্য গল্প এবং চিত্রনাট্য মনোনিত করা হয়। অনুদান প্রাপ্ত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক স্টেটমেন্ট বার্ষিক আয় দরকার হয়। কিন্তু কেন? যার একাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা থাকবে বা যে প্রতিষ্ঠানের একটি চলচ্চিত্র নির্মানের পর্যাপ্ত টাকা থাকবে তিনি কেন অনুদান পাবেন? আমার জানা মতে, এই অনুদান দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, যেসব পরিচালক মেধাবী অথচ টাকার অভাবে একটি ভাল চলচ্চিত্র নির্মান করতে পারছে না। তাকে বা তার মেধাকে বিকশিত করতে সরকারী ভাবে অনুদান প্রদান করা হয়। অথচ আমাদের সরকারী অনুদান সম্পূর্ন ভুল পদ্ধতিতে প্রদান করা হয়। আবেদনের সাথে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার বিবরন প্রদান করার অর্থ কি? তাছাড়া প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নামে কেন অনুদান বরাদ্দ করা হয়? আমার প্রশ্ন হলো অনুদান প্রদানের সময় যেমন যাচাই -বাছাই কমিটি করা হয়, মুক্তির সময় কেন যাচাই বাছাই কমিটি থাকে না? একটি চলচ্চিত্রের স্ক্রিন দেখে বোঝা যায় তাতে কত টাকা লগ্নি করা হয়োছে। মাননীয় অনুদান কমিটি কখনো কি যাচাই করেছে, যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেই মানের চলচ্চিত্র নির্মান করা হয়েছে কিনা? মাঝে মাঝে সংবাদ প্রচার হয় যথাসময়ে অনুদানের ছবি শুটিং শেষ করতে না পারায়, তথ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক মামলা করা হয়েছে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান অনুদান পেলে কোন কথা নেই। তবে কোন পরিচালক যখন অনুদান পান, তখন ঘটে বিপত্তি। কারন অনুদানের টাকা মধ্য স্বত্বভোগীদের হাতে শর্ত অনুযায়ী চলে যায়। ফলে টাকার অভাবে শেষ পর্যন্ত ছবিটির শ্যুটিং আটকে যায। অনেকেই মনে করেন অনুদানের টাকা পরিচালক ব্যক্তিগত কাজে খরচ করেন। ধারনাটি সম্পূর্ন ভুল। এ পর্যন্ত যত পরিচালক অনুদান পেয়েছেন তারা কেউ-ই আর্থিক ভাবে রাতারাতি  লাভবান হয়নি। সুতরাং অনুদানের টাকা প্রযোজক বা পরিচালকের হাতে আসতে আসতে কমতে থাকে। নির্মানের সময় অঙ্কটা এতই ছোট হয়ে যায় যে, তা দিয়ে চলচ্চিত্রের অর্ধেক কাজ শেষ করা সম্ভব। 

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারী অনুদান প্রাপ্ত অর্ধেকেরও বেশি চলচ্চিত্র এখনো মুক্তি পায়নি। ২০০৭ থেকে ২০১৭ পযর্ন্ত মোট ৪১টি চলচ্চিত্রের মধ্যে মুক্তি পেয়েছে মাত্র ১৫টি। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সরকারী অনুদানের যেসব ছবি মুক্তি পায়নি সেগুলো হলো ১৯৭৬ সালে বেবী ইসলামের মেহেরজান। ২০০৭ সালে এনমুল করিম নির্ঝরের নমুনা। ২০০৮ সালে জুনায়েদ হালিমের স্বপ্ন ও দু:স্বপ্নের গল্প। ২০১০ সালে মির্জা সাখওয়াৎ হোসেনের ধোকা। ফারুখ হোসেনের কাক তাড়ুয়া। ২০১১ সালে মারুফ হোসেনের নেকড়ে অরন্য। সালাউদ্দিন জাকির শিশুতোষ ছবি একা একা। প্রশান্ত অধিকারীর হ্যাডসনের বন্দুক। ২০১৩ সালে ড্যানি সিডাকের কাসার থালায় রূপালী চাঁদ। ২০১৪ সালে নুরুল আলম আতিকের লাল মোরগের ঝুটি। এন রাশেদ চৌধুরীর চন্দ্রাবতী কথা। মাহমুদ দিদারের বিউটি সার্কাস। ২০১৫ সালে এসডি রুবেলের বৃদ্ধাশ্রম। কামরান আহমেদ সাইমনের শঙ্খধ্বনি। ২০১৬ সালে লোনা জলের কাব্য, রূপসা নদীর বাঁকে, আজব সুন্দর, প্রিয় জন্মভুমি, দায়মুক্তি। ২০১৭ সালে কালবেলা, আজব ছেলে, অবলম্বন। এছাড়া নার্গিস আক্তারের যৈবতী কন্যার মন এখনো মুক্তি পায়নি।

মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের দিকে তাকালে বুঝতে পারি কত অবহেলা আর অনাদরে এসব সিনেমা হাতেগোনা কয়েকটি সিনেমা হলে আলোর মুখ দেখতে না দেখতেই  আবার অন্ধকারে মুখ থুবেড়ে পড়ে থাকে। প্রশ্ন হলো, এমন গল্প কেন বেছে নেওয়া হচ্ছে যা জনগন আগ্রহ নিয়ে দেখছে না। চলচ্চিত্র নির্মানের উদ্দেশ্য থাকে বাণিজ্যিক ভাবে লাভবান এবং জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য। অথবা উচ্চমার্গীয় আর্ট ফিল্ম। যা দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক প্রশংসনীয় এবং পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। সরকারী অনুদান প্রাপ্ত এসব চলচ্চিত্র কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে আমার বোধগম্য নয়। সুতরাং অতিসত্বর অনুদানের নামে অর্থ আত্মসাৎ বাণিজ্য বন্ধ করা উচিত। বরং অনুদানের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ বিএফডিসি'তে বিনা সুদে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লোন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। এখান থেকে সহজ শর্তে লোন নিয়ে ভালমানের চলচ্চিত্র নির্মান করা হবে। চলচ্চিত্র মুক্তির পর লোনের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। তবে যদি কেউ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে না পারে তার জন্য বিলম্ব ফি নির্ধারন করা যেতে পারে। এভাবে সরকারী অনুদানের টাকার যথাযথ মুল্যায়ন হবে পারে। এতে বিএফডিসি আবার মুখরিত হবে চলচ্চিত্র প্রেমীদের পদচারনায়।চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বেকারত্ব ঘুচিয়ে কাজে নিয়েজিত হবে। সিনেমা হল মালিকরা লাভবান হবেন এবং দেশের জনগন পাবে ভাল মানের চলচ্চিত্র। সুতরাং মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে অনুদানের টাকা রক্ষা করতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

(www.theoffnews.com - Bangladesh film subsidies)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours