মাটির বিস্ময়কর ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষ জানে খুবই কম। এই বিশ্বের সবচেয়ে হেলাফেলার বস্তুগুলোর একটি হলো মাটি। মানুষের কাছে মাটি মানে হলো নেহাতই প্রাণহীন নির্জীব ধুলোবালি। কিন্তু এই ধারণা শুধু ভুল নয়, চরম ভুল- বলছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রাণহীন ধুলো-কাদা তো নয়ই বরঞ্চ মাটি এতটাই জীবন্ত যে এক গ্রাম ওজনের মাটিতে ৫০ হাজার প্রজাতির মাইক্রো-অর্গানিজম বা অণুজীব থাকতে পারে। এই বিশ্বের জনসংখ্যা যত, এক চায়ের চামচ সমান মাটিতে তার চেয়েও বেশি অণুজীব থাকতে পারে। পায়ের নিচে এই লুকোনো যে জগত, সেখানকার যে বিশাল কর্মযজ্ঞ - এখনও মানুষ তার সামান্যই জানে। কিন্তু মাটির নিচে এসব জীব এবং অণুজীব দিন-রাত বিস্ময়কর অমূল্য সব কাজ করে চলেছে।
কোটি কোটি বছর ধরে অভিযোজনের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এসব অণুজীব অ্যান্টিবায়োটিক উপাদান তৈরি করছে। মানুষ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে বাঁচতে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে তার অনেকগুলোর ভিত্তিই হচ্ছে মাটির নানা অণুজীবের তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক।সুতরাং আমরা জীবন রক্ষার ওষুধ পাচ্ছি মূলত মাটি থেকে। এবং আমরা জানি না আমাদের পায়ের নিচে মাটির তলে চিকিৎসার আরো কত সূত্র চাপা রয়েছে। মাটির নিচে বিশেষ যে প্রাণীটি তৎপর তা হলো - কেঁচো।
বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন কেঁচো নিয়ে এতটাই বিস্ময় বোধ করতেন যে তিনি বলেছিলেন, এই বিশ্বের ইতিহাসে কেঁচোর মত আর কোনো প্রাণী এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হয় না।
কারণ কেঁচো শুধু মাটি তৈরিই করে না, মাটির সুরক্ষা করে। মাটির নিচে এই প্রাণীর চলাচলের ফলে যে খালি জায়গা তৈরি হয় তাতে গাছ তার শেকড় বিস্তারের সুযোগ পায়। আর মাটিতে নিচে ফাঁকা জায়গা তৈরি হওয়ার মাটির শক্তি বাড়ে। সেই সাথে মাটির নিচে ছড়িয়ে রয়েছে ফাঙ্গি বা ছত্রাকের বিশাল এবং জটিল জাল। গাছ-পালা এবং ছত্রাক বেঁচে থাকার জন্য একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। ফলে তাদের মধ্যে দেয়া-নেয়ার খেলা চলে।
গাছের মত ফাঙ্গি বা ছত্রাক কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নিয়ে বাড়তে পারে না, কিন্তু মাটির নিচ থেকে পুষ্টি শুষে নিতে তারা অধিকতর পারদর্শী। ফলে, গাছ ও ছত্রাকের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং পুষ্টির লেনদেন হয়। পাশাপাশি, গাছ বা গাছের অংশবিশেষ মরে যায় বলে অণুজীব তা থেকে খাবার পায়। ঐ সব অণুজীব আবার পোকা মাকড়ের খাবার। পাখি আবার ঐ সব পোকামাকড় খায়। এভাবেই নিরলসভাবে চলতে থাকে প্রকৃতির এই প্রক্রিয়া। মানুষ যা খায় তার প্রায় সবটাই কোনো না কোনোভাবে মাটি থেকেই আসে। কিন্তু বিষয়টা শুধু এমন নয় যে মাটি আমাদের জন্য কী কী করছে? মাটির গুরুত্ব অনুধাবন করা, মাটির সুরক্ষা আরো নানা কারণে জরুরি।
মাত্র পাঁচ বর্গ মিলিমিটার মাটি সৃষ্টি হতে ১০০ বছরেরও বেশি সময় লাগ। কিন্তু বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে, নগরায়নের কারণে বা ভূমিধসের কারণে মুহূর্তে সেই মাটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কিছু মাটি বহু পুরনো- কোটি কোটি বছর পুরনো। মনে করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো মাটি রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় যা ৩০০ কোটি বছর আগে তৈরি। ব্রিটেনের মাটির বয়স ১৫০০০ বছর যা সর্বশেষ বরফ যুগের পরপরই তৈরি হয়েছিল।
কার্বন সঞ্চয় করে রাখার জন্য মাটির গুরুত্ব অপরিসীম। কার্বন শুষে তা ভূপৃষ্ঠের বহু নিচে আটকে রাখে মাটি। গাছপালা যত কার্বন ধরে রাখে তার তিনগুণ থাকে মাটিতে । সুতরাং অমূল্য যে সম্পদ অতি ধীরে তৈরি হয়, তার সুরক্ষা আমরা করতে পারছি না।
উদ্বেগের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তাদের অন্যতম - ব্যাপক বাণিজ্যিক চাষাবাদ। এর ফলে মাটিতে জমা কার্বন বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে মাটি নতুন করে তৈরি হতে যে সময় লাগবে তার চেয়ে ৫০ বা একশগুণ দ্রুত গতিতে আমরা কার্বন হারাচ্ছি।
(www.theoffnews.com - Bangladesh soil)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours