তৃপ্তি মিত্র, লেখিকা ও আবৃত্তিকার, কলকাতা:

কালীঘাট মন্দির বাংলার ঐতিহ্য এবং কলকাতার অহংকার৷ সেই কালীঘাট মন্দির এবং কালীমাতার অস্তিত্ব নিয়ে লোকমুখে নানান গল্প শোনা যায়। তবে প্রচলিত গল্প গাছা যাই থাক না কেন, কালীঘাটের কালীমাতার অস্তিত্বের বর্ণনা মঙ্গলকাব্যে উল্লেখ আছে৷ বিপ্রদাস পিপলাই রচিত "মনসা বিজয়"(১৪৯৫) কাব্যে যেখানে এভাবে বলা আছে —

"কালীঘাটে চাঁদো রাজা কালিকা পূজিয়া

চূড়াঘাট বহি যায় জয়ধ্বনি দিয়া।"

মুকুন্দরাম রচিত "চন্ডীমঙ্গল" কাব্যে যেখানে উল্লেখ আছে —

"বালুঘাটা এড়াইল বেনের নন্দন

কালীঘাটে গিয়া ডিঙ্গা দিল দর্শন।"

আবুল ফজলের "আইন-ই-আকবরীতে কালীঘাটের উল্লেখ আছে "কালীকোট" নামে৷

ঐতিহাসিকদের মতানুসারে গুপ্তরাজাদের আমলে "কালীঘাট" পুণ্যস্থান রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করে৷ শোনা যায় কালীঘাটের মাটির নীচে গুপ্তযুগের মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল৷ দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমি রচিত ম্যাপে কালীঘাট অঞ্চলকে 'কালীগ্রাম' বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷

বঙ্গদেশ নদী মাত্রিক দেশ হবার ফলে বণিকগণ জলপথকেই ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে ব্যবহার করতেন। কালীঘাটের পাশ দিয়ে প্রবাহিত আদিগঙ্গার বুকে এই সব বাণিজ্য তরী, বজরা ভেসে যেত৷ প্রয়োজনে তারা বিভিন্ন ঘাটে ভিড়ত। যে সব স্থানে দেব দেবীর মুর্তি পেত সেখানে নিজেদের এবং পথের নিরাপত্তা ও ব্যবসা বানিজ্যের উন্নতির জন্য পুজা অর্চনা করত৷ জঙ্গলাকীর্ণ দক্ষিণাকালীর এই ঘাটটি তেমনই একটি ঘাট৷ যে ঘাটে নেমে অনেকে দেবীর দর্শন করত এবং পুজা দিত৷ তখন এই ঘাটকে কালীদেবীর ঘাট বলে ডাকা হত৷ কালক্রমে যার নাম হয়েছে কালীঘাট৷

কালীপুজো হল অস্ট্রিক জাতি বা অস্ট্রিক সভ্যতার অবদান৷ শিলার প্রতীক, কারণ বারি সেবন, বলি প্রথা এবং কৃষ্ণকালী, দ্বিগম্বরী, ভয়ঙ্করী দেবী মুর্তি যেগুলি অস্ট্রিক সভ্যতার অরিজিন৷ ঠিক তেমনি নদ নদী, গাছ পুজো, বন দুর্গা পুজো, অলক্ষ্মী পুজো এমন কি কলা বৌ পুজো অস্ট্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তীত রূপ৷

কালীঘাট পীঠস্থান হয়ে ওঠার পেছনে মহা তপস্বী দুই সাধক আত্মারাম ব্রক্ষ্মচারী এবং ব্রক্ষ্মানন্দ গিরির অবদান স্বীকার করতেই হয়৷ পরবর্তী কালে কামদেব পদ্মাবতীর ভূমিকা ও অনেক খানি৷ পরবর্তী কালে বিভিন্ন মোহান্তরা কালীঘাটের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন৷ ক্রমে যোগী সন্ন্যাসী, মোহান্তর পরে গৃহী ভক্তের কাছে মন্দিরের দায় ভার চলে আসে৷ যে বিধি এখনও বিদ্যমান৷ বৈষ্ণব ভবানীদাস চক্রবর্তীর সময় থেকে কালীঘাটের মাকে শ্যাম ও শ্যামার উভয় রূপে পুজো করা হত৷

মায়ের মুর্তিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কপালে, নাকে বৈষ্ণব মতে রসকলি আঁকা আছে৷ মায়ের যে রূপ আর কোথাও দেখা যায় না৷ কালীঘাটের কালীমাতার আর একটি বৈশিষ্ট্য হল কার্তিক মাসের অমাবস্যার তিথিতে কালীপুজোর দিন কলীপুজো হয় না৷ হয় দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো৷ বছরের অনান্য অমাবস্যা তিথিতে কালীপুজো হলেও এদিন কিন্তু কালীঘাটে শ্যামালক্ষ্মী বা দীপান্বিতা লক্ষ্মী পুজোর প্রচলন যুগ যুগ ধরে কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েত গন বহন করে আসছেন৷ যে রীতি আজও সমান ভাবে বিদ্যমান৷ আমরা যে তিন প্রকার পুজা বিধি জানি৷ অর্থাৎ নিত্যপুজা, নৈমিত্তিকপুজা এবং কাম্যপুজা ৷ কালীঘাটের এই শ্যামালক্ষ্মী পুজা হল কাম্যপুজা ৷ যে শ্যামাকালী ছিল সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের ইষ্টদেবতা৷ সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের আদি পুরুষ বসন্ত রায় ছিলেন কালীঘাটের বর্তমান সেবায়েতের আদি পুরুষের মন্ত্র শিষ্য৷ তাঁরাই কালীঘাট মন্দিরের চালা মন্দিরকে পাকা পোক্ত মন্দিরের রূপ দেন। কালীঘাটের মায়ের অনুরূপ একটি মুর্তি খেপুত উত্তরবাড় বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করে সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশ একই রীতি অনুসরন করে পুজা অর্চনা করে আসছেন৷

কালীঘাট শক্তিপীঠ হয়ে ওঠার পেছনে আছে একটি পৌরাণিক কাহিনী৷ তবে এটি শুধু পৌরাণিক কাহিনী নয়৷ বরং নীতি উপদেশ বা ধর্মীয় অনুশাসন বললে ও ভুল হবে না৷ কারন সমস্ত ধর্মীয় উপাখ্যানের অন্তরালে থাকে সমকালীন সনাতন এবং অবশ্য পালনীয় নীতি উপদেশ৷ এমনই একটি পৌরাণিক কাহিনী হল "দক্ষযজ্ঞ"৷ যে দক্ষযজ্ঞের কাহিনী আমরা বই না পড়ে ও অল্প বিস্তর সবাই জানি৷ বিভিন্ন পালা গান বা যাত্রাপালার মাধ্যমে৷ যে কাহিনীর মধ্যে যেমন পতিব্রতা এক নারীর চরম স্বর্গীয় সুষমা মন্ডিত রূপ ফুটে উঠেছে৷ অপর দিকে দম্ভ, ক্রোধ ও প্রতি হিংসার চরম নিপাতের দৃষ্টান্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷

প্রকৃতির প্রথম শক্তি সতীর সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেবের যুগল মিলন ঘটেছিল সে কথা আমরা জানি৷ মহাদেব সর্বশক্তিমান হয়েও ছিলেন আত্মভোলা, জটাজুট ধারী, উদাসীন ও নিরহংকার৷ পরণে যার বাঘ ছাল, ভস্ম মাখা শরীর৷ তেমন জামাতাকে রাজা দক্ষ কোন কালেই মেনে নিতে পারেননি৷ কন্যা সতী দক্ষের আয়োজিত যজ্ঞ বাসরে পতি নিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহ ত্যাগ করেছিলেন৷ মহাপ্রেমিক মহাদেব ক্ষুব্ধ হয়ে সতীর দেহ কাঁধে তুলে তান্ডব নৃত্যে যখন মেতে উঠেছিলেন৷ দেবতা বিষ্ণু তাঁর ক্রোধ সংবরন করার জন্য সতীর দেহকে সুদর্শন চক্র দিয়ে খন্ড খন্ড করে দিয়েছিলেন৷ সেই খন্ডিত দেহাংশ দক্ষের রাজধানী কনখল থেকে অবিভক্ত ভারত বর্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল৷ কালীঘাটে পড়েছিল একান্ন টুকরোর একচল্লিশ তম দেহাংশ৷ কাহিনী অনুসারে এখানে পাওয়া গিয়েছিল সতীর ডান পায়ের চারটি আঙুল৷ এজন্য এই স্থানকে পাদপীঠ ও বলা হত৷ অনান্য যে সব স্থানে সতীর দেহের অংশ পড়েছিল৷ সেই স্থানগুলি "সতীপীঠ "নামে খ্যাত৷ ভক্ত কুলের কাছে সেই স্থানগুলি অতি পবিত্র এক তীর্থস্থান৷ কালীঘাট তেমনই এক মহা তীর্থস্থান৷ যা কালীঘাট "মহাসতীপীঠ" নামে খ্যাত।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours