মৌসুমী প্রামাণিক, লেখিকা, কলকাতা:

রাজনৈতিক দূরদর্শিতা... 

স্বাধীনতা পূর্ব যুগ থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে সবচাইতে প্রাসঙ্গিক একটি কথা। দেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কোন কোন সময় বিদেশমন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ইত্যাদি পদাধিকারীদের ক্ষেত্রে এই শব্দযুগলের ইম্পর্টেন্স মেপে শেষ করা যাবে না। গান্ধীজীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নিয়ে কোন দ্বিমত ছিল না বলেই তিনি আজও মহাত্মা। ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আজও তাঁকে সর্বকালের সেরা প্রধানমন্ত্রীরূপে স্থান করে দিয়েছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীকে এই কারণেই চাণক্য আখ্যা দেওয়া হয়েছে। নেপোটিজমের শিকার না হলে তিনি হয়তো দেশের সবচাইতে সেরা প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। একই কথা সুভাষচন্দ্র বোসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

তবে আজকের দিনে যে দল ক্ষমতার কেন্দ্রে এবং তাদের প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা ক্ষমতায় টিকে আছেন অর্থ ও সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদি দপ্তরকে মিসইউজ করে। তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আছে কি নেই সেটা বিচারের আগেই তাদের রাজনৈতিক জমি দখলের লোভ ও আকাঙ্খাকে প্রাধান্য দিতেই হচ্ছে। ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বদলে হিন্দু রাষ্ট্র করার লক্ষ্যে এবং বিশেষ কয়েকজন শিল্পপতির হাতে দেশের সম্পদ তুলে দেওয়ার লক্ষ্যকেই তারা পাখির চোখ করেছেন। সুতরাং আগ্রাসী মনোভাব যেখানে প্রাধান্য পায়, সেখানে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থাকলেও যে তা ব্যাকফুটে চলে যায়, বলাই বাহুল্য।

তবে ভারতবর্ষ যখনই সংকটময় পরিস্থিতির সামনে উপনীত হয়েছে, বাঙালি ব্রেন রাজনীতির ইতিহাসে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। তাই বোধহয় বর্তমানের শাসক দল বাংলা দখলের জন্য এত মরিয়া। সেটা বাঙালী বুদ্ধিকে ক্ষমতা দিয়ে পরাস্ত করতে নাকি, বাঙালীদের বুদ্ধি ধার করে নিজেদের তথা দেশের উন্নতিসাধন করতে তা সময়ই বলবে। যদি আদৌ তারা ক্ষমতায় আসে তখনই সেটা জানা যাবে।

কোন কোন মহলের মতে তারা ক্ষমতায় এলে নাকি বাঙালিয়ানাকে ধ্বংস করে দেবে। বাঙালির ঐতিহ্য কালচার এতটাই রিচ যে সেটাকে ধ্বংস করা মুখের কথা নয়। একদল যদিবা বাংলাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়; প্রতিবাদী একদল এর বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াবেই; কারণ বাঙালী এখনও নস্টালজিক, বাঙালী এখনও সাহিত্য, নাটক নিয়ে চর্চা করছে এবং নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পরম্পরাকে বয়ে নিয়ে চলেছে শুধুমাত্র প্যাশানের জোরে। এই প্যাশানটাই বাঙালীর সবচাইতে বড় পুঁজি যা ভারতের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া ভার।

মোদ্দা কথা বাঙালীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা শুধু বুদ্ধি নয় খানিকটা ইমোশান দিয়েও পরিচালিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ তুলে ধরতে পারি আমাদের রাজ্যের প্রত্যেক মুখ্যমন্ত্রী কথা। ডঃ বিধানচন্দ্র রায় রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে ফ্রি অফ কস্ট ডাক্তারিটাও তো করে গেছেন। জ্যোতিবসুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নিয়ে কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না। প্যাশান বা ইমোশান ছিল বলেই তো নিজের দলকে রাজ্যের চাইতেও বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলেছিলেন। সিদ্ধার্থশংকর রায় অনেকটাই গান্ধী-নেহেরু পরিবার দ্বারা পরিচালিত মুখ্যমন্ত্রী। তবে শুনেছি তিনি জ্যোতি বসুর সঙ্গে সখ্যতা শেষদিন পর্যন্ত্য ভাঙেননি।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য ব্যক্তি হিসাবে সংস্কৃতি মনস্ক আর যে কোন সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমীরই আবেগ বা প্যাশান যথেষ্ট পরিমানে থাকে। তবে উনি ওনার দূরদর্শিতা দেখানোর সুযোগ খুব বেশি পাননি কারণ দলের নীচুতলা তখন ওপরতলার মাথায় উঠে নাচতে শুরু করেছিল। ওনার যদি একার ক্ষমতায় সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ থাকতো হয়তো পশ্চিমবঙ্গ অন্য কিছু দেখতে পেত; কিন্তু তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি কখনোই তত্ত্বের উর্ধ্বে উঠে ফ্লেক্সিবল হতে পারেনা। বিপ্লব করতে ট্রিমেণ্ডাস প্যাশান লাগে আর সরকারে থেকে রাজ্য তথা দেশ পরিচালনা করতে ততোধিক দূরদর্শিতা লাগে। দুটো একস্ট্রিম একসঙ্গে কিভাবে সম্ভব? পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম দল আজও তাই তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি। তাই তাদের ক্ষমতায় আসার চান্স এখনও মাইনাসেই রান করছে।

যে বা যারা ভাবছেন যে তৃণমূল কংগ্রেসকে হারিয়ে বিজেপি এলেই তাঁরা আবার শ্রেণী বিভাজনের পলিটিক্স করে ক্ষমতায় আসবে; তার মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন; তারা অকারণে নিজেরাই নিজেদেরকে কনফিউজড করছেন। জিস্ট এটাই যে বর্তমান সিপিএম দলে বুদ্ধিমান, চতুর লোক অনেক আছেন, কিন্তু রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বা রাজনৈতিক পরিপক্কতা তাঁদের কারোরই নেই। এইখানে আমার দূরদৃষ্টি কিছু কথা বলছে। কমিউনিস্ট প্রত্যেকটি দলের যেটা এই মুহূর্তে করা উচিৎ, সেটা হলো এই যে ক্ষমতার লোভ ত্যাগ করে মানুষের পাশে থেকে, সঙ্গে মিশে গিয়ে বিপ্লব সংগঠিত করা। বলতে দ্বিধা নেই শুধু রাজ্য নয় দেশের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে বিশাল জনজাগরণের প্রয়োজন এসে পড়েছে। আর কমিউনিস্টদের থেকে ভালো কেউ আর এর নেতৃত্ব দিতে পারবে না; এটা আমার বিশ্বাস; অনেক মানুষেরও বিশ্বাস। তবে তত্ত্বগুলোকেও খানিক ব্রাশ আপ করতে হবে।

যে গরীবদের পাশে থেকে, শ্রমজীবি মানুষের পাশে থেকে তারা রাজনীতি করতে অভ্যস্ত, তাদের মানসিকতায় প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। তারাও অর্থলোভী হয়ে উঠছে দিনকে দিন। বাড়ির কাজের লোকের ছেলেরা আজকাল এক কথায় এক লাখ টাকা ক্যাস দিয়ে বাইক কিনে চড়ছে। গ্রামে গ্রামে বালি, মাটি টাকা হয়ে উড়ছে। ভাতা ও ভর্তুকি দ্রব্য বিক্রি করে যে যার মতো করে ব্যবসা করে খাচ্ছে। একদিন পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করতে গিয়ে যাদের কর্মসংস্থান করে দিয়েছিল তাদের ৯০% আজ বিজেপির কট্টর সমর্থকে পরিণত।  সুতরাং বামেদেরও খানিকটা ফ্লেক্সিবল হতে হবে; মানুষের মন রীড করতে জানতে হবে। এই মুহূর্তে গরীব বা দিন আনি দিন খাইয়ের তুলনায় সংস্কৃতি মনস্ক মধ্যবিত্ত সমাজকে কাছে পাবার চেষ্টা করাই ভালো।

তাহলে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা কি? অত্যন্ত শোচনীয়। সেই রাজীব গান্ধীর সময় থেকে মমতা ব্যানার্জীকে রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে ভারতের রাজনীতির আঙিনায় এই মুহূর্তে তিনি সবচাউতে তুখোড় রাজনীতিবিদ। যদিও তিনি অসম্ভব আবেগপ্রবণ; মাথা গরম করে উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলেন। ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি যে কোন কাজ করেননি বা পশ্চিমবঙ্গের ভালো চান না একথা ওনার চরম শত্রুও মানবে না। জঙ্গলমহলে ও দার্জিলিংএ স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা মুখের কথা ছিল না। গ্রামে ও শহরের সৌন্দর্য্যায়নেও তাকে ফুল মার্কস দেওয়া যেতে পারে। তবে কর্মসংস্থান করতে না পারা ও ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে অহেতুক তোষন তাঁর সবচাইতে বড় বিফলতা।

প্রথম থেকেই কেন যে তিনি এত ইনসিকিওরড কে জানে? পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে যে পপুলার মুখ্যমন্ত্রী মুখ না থাকলে সেই দল কখনোই ক্ষমতায় আসেনি। এখন তো তেমন কোন পপুলার মুখ নেই; কোন দলেরই নেই। তবু ওনার এত ভয় কিসের? (আর্থিক দুর্নীতি সব দলের নেতারাই যুক্ত তাই ঐ বিষয়টাকে আজকের প্রতিবেদন থেকে ছাড় দিচ্ছি।) পশ্চিমবঙ্গের মানুষের একটা বড় অংশ ওনাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আর পছন্দ করছে না আবার এটাও চাইছে যে যে বিজেপি ক্ষমতায় আসুক। ওনার দলের তাবড় নেতারাও কি ওনাকে আর মুখ্যমন্ত্রীপদে চাইছেন। এই মুহূর্তে যে বা যারা ওনার ব্রেনওয়াশে ব্যস্ত, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই মুখ্যমন্ত্রী হবার সখ জেগেছে। ঈশ্বর না করুন তাঁর অ্যাবসেন্সে একজন সংখ্যালঘুকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কি মেনে নেবে? নেত্রীকে এখন থেকেই ভাবতে হবে সেকথা। সেক্ষেত্রে একটাই কাজ এই মুহূর্তে ওনার করা উচিৎ শুভেন্দু অধিকারীকে সামনে রেখে পরবর্তী নির্বাচনে অ্যাপিয়ার হওয়া। অনেক হয়েছে। এবার বৃহত্তর রাজনীতির কথা মাথায় রেখে নিজেকে দিল্লীতে নিয়ে গিয়ে সেটেল্ড করান।

না। ওনাকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী রূপে কেউ দেখছে না। উনি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেই সফল হতে পারেন নি তো প্রধানমন্ত্রী দূর অস্ত। সমগ্র ভারতের ভালোর জন্য দিল্লীতে একটা বদলের আশু প্রয়োজন। আঞ্চলিক দল ও কংগ্রেসের সঙ্গে সমন্বয় তৈরী করে সে পথে এগোনোর কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখাই সমীচীন বলে মনে হয়। আর ওখান থেকে ছোট, বড়, মাঝারি শিল্পপতিদের পশ্চিমবঙ্গে পাঠানোর কাজটাও সহজ হবে বলে মনে হয়। যেকোন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠা না হলে বাংলার থেকে কৃতী ছাত্র-ছাত্রী অন্য রাজ্য বা দেশে চলে গেলে যেসব আগাছাগুলো পড়ে থাকবে, তাদের দিয়ে রাজনৈতিক জমি উদ্ধার আর তোলাবাজি ছাড়া আর কিছু সম্ভব হবে না। বাংলার কোন ভালো হবে না। আর বাংলার মানুষও উত্তরত্তোর রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেই থাকবে। অধৈর্য্য হয়ে গিয়ে হয় রাজ্য ছাড়বে কিংবা মৌন-বধির হয়ে বসে থাকবে। স্বার্থপর, নিজের গণ্ডিতে থেকে আয়েশ করা মানুষের সংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পাবে যে পশ্চিমবঙ্গ নামটাই তখন ইতিহাস হয়ে রয়ে যাবে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours