কাকলি সেনগুপ্ত, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
স্মৃতির পাতা উল্টে দেখা গেলে, যেভাবে তাঁকে সবাই চিনেছিল, আমার চেনা ছিল তার চে়য়ে আলাদা। আমার বয়েস, বা তার কাছাকাছি বয়েসের ছেলে বা মেয়েরা যখন তাঁকে ফেলুদা বলে চিনল, আমি তখন-ই তাঁকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামে চিনি। বাবা বলেছিলেন, উনি অভিনেতা। যে সময়ে দাঁড়িয়ে বাবা অভিনেতা চিনিয়ে ছিলেন, আমার সে বয়েস অবশ্য ‘অভিনেতা’ শব্দের অর্থ অনুধাবনের বয়েস ছিল না। আমার বয়েস তখন চার। অথবা তাও নয়, পাঁচ হয়ত বা। মনে নেই এখন আর। শুধু মনে আছে যে, স্টার থিয়েটারে মহা ধূমধাম। নাটক হবে, লক্ষণের শক্তিশেল। বাড়ি থেকে যাব আমি, যাবে বাবা। সাদার ওপর ভায়োলেট পোলকা ডট জামা, মাথায় ওই একই কাপড়ে তৈরি হেয়ার ব্যান্ডে সেজে চললাম বাবার হাত ধরে। নাটকের কথা বলতে, মঞ্চ জুড়ে জাম্বুবান বানর আর হনুমানের সারি। গন্ধমাদন পর্বত এনে লক্ষণের মাথায় বসিয়ে দিল হনুমান। এটুকু ফুরোনোর পরে সবাই যখন বেরিয়ে আসছে পায়ে পায়ে, তখন ভি়ড জমতে শুরু করল বাইরে। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখলাম, লাল জামা আর সাদা প্যান্ট পরা একজন, আমার মতন দুটো বাচ্চার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আর তাঁকে ঘিরে অনেক মানুষ। বাবা বললেন, এই যে দেখছ, এই ভদ্রলোকের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর বাচ্চা দুজন ওঁর ছেলেমেয়ে। বাড়ি ফিরে মাকে গল্প বলেছিলাম। সাদা মতন লোক, অভিনেতা। বাবার থেকে উঁচু। আমার ভালো লাগেনি।
এরও অনেক বছর পরে, ২০১৮'তে বোধহয়। মুখোমুখি দেখলাম আবার। আগেও দেখেছি, একাডেমিতে নাটক দেখতে গিয়ে। তবে, তা এমন মনে রাখার মতো কিছু নয়। ডাক্তার-নাট্যকার-নির্দেশক ও কবি অমিত রঞ্জন বিশ্বাসের কবিতার বই ‘মেত্তাবীজ’ এর প্রকাশ অনুষ্ঠান ছিল সেদিন, সে ছিল এমনই নভেম্বর। পরিণত বয়েসের অবজার্ভেশান এমনিতেই অন্যরকম হয়। আর আমি তাঁর গল্প শুনেই বড় হয়েছি। আসলে আমার মার সঙ্গে একই বছরে বি এ পরীক্ষা দিয়েছিলেন দীপা চট্টোপাধ্যায়। সিট পড়েছিল একই কলেজে। মার বন্ধু শেফু মাসি নাকি একদিন মাকে বলেছিলেন, বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেছিলেন, উত্তম কুমার এসেছিলেন কলেজে, জানিস? মা বলেছিলেন, কী যে বলিস? শেফু মাসি বলেছিল, হ্যাঁরে, একটা মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, তাকে পৌঁছে দিতে আসেন। সবাই বলল, গার্লফ্রেন্ড। মা হেসে বলেছিলেন, তাহলেতো হতেই পারে না। আচ্ছা, ছুটির সময়ে দেখা যাবে। ছুটির সময়ে দেখা গেল, উনি মোটেই উত্তম কুমার নন, উনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
এরপর, আমি তাঁকে দেখেছি পর্দায়, স্টেজে। আরও, আরও যে সব জায়গায় তাঁর বিস্তার, সেই সবটুকুর খবর রাখতাম। অন্ধত্ব ছিল না, ভালো লাগা ছিল। এবারে সেদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলি। ক্যাফেটি মুখর হয়ে উঠেছিল তাঁর উপস্থিতিতে। গমগম করে উঠছিল তাঁর শব্দচয়ন, তাঁর উজ্জ্বল উচ্চারণে। তাঁর উপস্থিতিতে কবিতা পড়তে গিয়ে, আমিও গলাত এনেছিলাম সবটুকু আত্মবিশ্বাস। তারপর তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলাম, আপনাকে ছোটবেলায় একটুও পছন্দ করতাম না। উনি হেসেছিলেন। আমি বলতে পেরে কৃতার্থ হয়েছিলাম। অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন। তাঁর সবটুকুই খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল যে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours