রমা চক্রবর্তী, শিক্ষিকা, আবৃত্তিকার ও ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:
আমি তখন সদ্য সদ্যই স্কুলের চাকরীতে যোগদান করেছি| সবে মাত্র ২৩ বছর বয়স, বাকী যারা ছিলেন আমার সহকর্মী তারা বেশ প্রবীণ মানুষ| তখনকার একটি ঘটনা আজও আমার মনকে উথাল পাথাল করে, আজ ১৭ বছর পরেও যেন আমার চোখের সামনে ছবির মতো ভাসে|
একটি শিশু তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে, অন্যান্য শিশুরা ঐ শিশুটির সাথে মেলামেশা করে না, শ্রেনীকক্ষেও আলাদাভাবে বসে| এই বিষয়ে আমার সহকর্মীদের কাছে সদুত্তর পাইনি, যেহেতু তারা বয়সে একটু প্রবীণ তাই আমাকে বাচ্চা মেয়ে বলে অনেক কথা এড়িয়ে যেতেন|
ঐ বাচ্চা শিশুটিকে তার মা মাঝে মধ্যে স্কুলে দিতে আসতো| আমি তার সাথে শিশুটির বিষয়ে কথা বলতে গেলে সে অনেক রকম অজুহাতে এড়িয়ে যেতো, কথা বলতে চাইতো না|
একদিন আমি দুর্গাপুর--উখরা মিনিবাসে বাড়িতে ফিরছি। দেখলাম ঐ বাচ্চাটির মা ঐ বাসে উঠলো একটি বিশেষ স্টপেজ থেকে। যে জায়গাগুলোকে আমরা যারা ভদ্র ও সামাজিক জীব তারা একটু বাঁকা চোখে দেখি এবং বলাবলি করি "নষ্ট মেয়েরা থাকে" বলে|
সে তো আমায় দেখে ভীষণ লজ্জা পেলো এবং কুণ্ঠিত বোধ করছিল| এরপর বেশ কয়েকবার আমি ওকে দেখেছি ঐ স্টপেজ থেকে বাসে উঠতে| কোনো কোনো দিন তো সে আমাকে দেখলেই বাস থেকে নেমে যেতো এবং পরবর্তী বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতো|
এভাবেই অনেকদিন কেটে যায়। আমার মনে কৌতুহলও বাসা বাঁধে কিন্তু কোনো উত্তর পাই না। নিজের মনে ভীষণ অস্থিরতা বোধ করছিলাম|
এরপর একদিন স্কুলে Gurdian দের মিটিং ছিলো। বাচ্চাদের পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ২৬ শে সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে "মাতৃ সচেতনতা দিবস" হিসাবে একটি সাধারণ মিটিং|
সেইদিন আমি খুব সন্তর্পণে তাকে ফাঁকা পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। কিন্তু প্রথমে সে সবকিছু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমিও নাছোড়বান্দা। তারপর মিটিং শেষ হওয়ার পর সমস্ত Gurdian'রা চলে যাবার পর সে আমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এলো। এবং আমার হাত দুটো ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে তার জীবন ইতিহাসের বৃত্তান্ত বলে | তারপর আমি কয়দিন ধরে ভীষণ অস্থির মানসিকতায় কাটিয়েছি এবং তাকে ঐ জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। আমার কাছে নিয়ে আসবো ভেবেছিলাম। এই বিষয়ে তার সাথে কথা বলেছিলাম কিন্তু সে আমাকে এসব থেকে দূরে থাকতে বলেছিল এবং বলেছিল, "দিদিমনি ভগবান এক এক জনের ভাগ্য এক এক রকম ভাবে লেখেন। তুমি খুব ভালো, অন্য সবার মতো নও। তুমি আমার কথা ভেবেছো এটাই অনেক। কিন্তু আমি যে জালে বন্দী সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। অতীত আমাকে বাঁচতে দেবে না এই সমাজে, যা আছি ভালো আছি"|
ওর মুখেই শুনলাম এক অতীত "আমিনা"র জীবন কাহিনী। এই সমাজ এই পুরুষ যাকে বানিয়ে ছিল এক নষ্ট মেয়ে। এক অচ্ছুত মা। যার কলঙ্ক দাগ ইতিমধ্যেই লেপটে দেওয়া হয়েছে তার ছোট্ট মেয়েটির পরিমন্ডলে। শুনুন এক আমিনার আত্মকথা...
" দর্জি পাড়ার মেয়ে আমিনা।
বাবুদের বাড়ীতে কাজ করে।
বয়সে সবে মাত্র
কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে।
এরই মধ্যে সমাজ ওকে
পূর্ণ যুবতী করে তুলেছে।
জন্ম নিতেই মাকে হারালো।
বাপটাও মরলো কলেরায়।
বয়স যখন তার আঠারো।
আঠারোয় পা দেওয়া মেয়েটা
এই বিরাট পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা।
এর ওর বাড়ীর বাসন মেজে
দিন চলছিল আমিনার।
হঠাৎই একদিন যেন নেমে এল
ওর কপাল জুড়ে চরম সংকট অভিশাপ।
বাবুদের বাড়ীতে কাজ করতে গিয়ে
পড়লো এক রাক্ষসের হাতে।
রাতের অন্ধকারে মুখে কাপড় গুঁজে,
তাকে নিয়ে গেল পুকুর পাড়ের
ভাঙা মন্দিরের দালানে।
নষ্ট করলো আমিনাকে।
তার যৌবনের প্রথম আঘাতেই
সে বুঝতে পারলো,
এই বিরাট পৃথিবীটাতে
সে এখন অন্ধকারের আমিনা।
দিনের আলো মুছে গেছে তার।
নষ্ট করলো তাকে বাবুরা,
অথচ ঝলসানো চাঁদের মতো শুকনো দুটো রুটি
তার কপালে জুটলো না।
নষ্ট বলে তাকে কেউ কাজ দেয় না,
বাবুদের লালসার শিকার হয়ে
আমিনা এখন...
বাবুদের "দিল কি রানী"।
সে এখন নাচ দেখিয়ে পয়সা পায়।
যে আমিনা স্বপ্ন দেখতো
ঘর হবে, বর হবে,
সে এখন পয়সা দেখে।
যেমন পয়সা তেমনি নাচ।
নাচ দেখে পয়সা দেয় বাবুরা,
আর পয়সা দেখে নাচ দেখায় আমিনা।"
এ শুধু আমিনা নয়, এই রকম শত শত আমিনার ঘটনা আমার আপনার আশেপাশে অনবরত প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে|
কখনও দিল্লি, কখনও কলকাতা বা কখনও উত্তরপ্রদেশ| সারা ভারতবর্ষে এ ধর্ষণ যেন এক ব্যাধির আকার ধারণ করছে|
জানি না এই নরপিশাচ গুলো আর কতদিন পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে? আর জগৎ ভূমির মাটিকে কতদিন অপবিত্র করবে? এদের মান আর হুঁশ কোনোটাই নেই। তাই পৃথিবীতে এদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই| আসলে আমাদের আইন ব্যবস্থার মেরুদন্ড গুঁড়িয়ে গেছে। তাই এই নরপিশাচ গুলো সমাজে ঘুরে বেড়ায় কলার উঁচিয়ে| কখনও বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে। হায় ধর্ষিতা নারী তাই তুমি কখনও বসন্তের কোকিলের মতো হয়ে ওঠো কোনও ধর্মের, কোনও বর্ণের, কোনও জাতের বা কোনও রাজনীতির তাজা ইস্যুর। আর তোমার চোখের অশ্রুধারা? মূল্য যে তোমাকেই চোকাতে হয় একা। আজীবন...
(ধর্ষিতার আসল নাম পরিবর্তন করে এখানে নামকরণ করা হল 'আমিনা')
Post A Comment:
0 comments so far,add yours