তৃপ্তি মিত্র, লেখিকা ও আবৃত্তিকার, কলকাতা:

কোন কোন স্থানের বিশেষ কোন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ বহন থেকে উঠে আসে তার নাম৷ এই নাম লোক মুখে প্রচারিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত সেই নামটিই থেকে যায়। বর্তমানে কলকাতার "ধর্মতলা" একটি ব্যস্ততম অঞ্চল৷ যে অঞ্চলটির নাম করণের পিছনেও রয়েছে এমন নানান অজানা ইতিহাস ৷ যে ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি না। 

আগেই বলেছি কোন স্থানের নামের পেছনে থাকে কোন না কোন ইতিহাস ৷ তবে সে সব ইতিহাস বা বইয়ের পাতায় লেখা হয় না বলে বিকৃৃৃৃত হতে হতে আসল ইতিহাস হারিয়ে যায়৷ তবে এক্ষেত্রে Spot Dairy বা স্থানীয় প্রবীণ অভিজ্ঞ কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার অত্যন্ত জরুরি৷ বঙ্গদর্শন পত্রিকা এবং ভবানী রায় চৌধুরী রচিত "বঙ্গীয় সাবর্ণ কথা কালীক্ষেত্র কলিকাতা" নামক বইটি পড়তে পড়তে উঠে এসেছে এমন কিছু অজানা তথ্য৷ কিছু তথ্য ছোট বেলা থেকে গুরুজনদের মুখে শুনে শুনে স্মরণে থেকে গেছে৷ 

এক সময় এই জনপদে সব ধর্মের মানুষের বসবাস থাকার ফলে বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, গির্জা, মন্দির স্থাপন করা হয়েছিল৷ বহু লৌকিক দেবদেবীর পাশাপাশি ধর্মঠাকুরের পূজার প্রচলন ছিল৷ এই ঠাকুরের তেমন কোন অবয়ব নেই৷ কোন কোন স্থানে বৃক্ষতলে শিলাখন্ডে তিনি পূজিত হন ৷ সেই বৃক্ষতল বেষ্ঠিত স্থানকে থান বলা হয়৷ লোকমুখে সেই স্থানের নাম ক্রমে ক্রমে হয়ে যায় ধর্মতলা৷ 

আবার এমনও শোনা যায় ধরমতুল্লা নামে একটি মসজিদ থেকে নাকি এমন নামকরণ করা হয়েছে। 

ধর্মতলায় "চার্চ অব সেক্রেস হার্ট অফ জিজাস " চার্চের ভিতরে ১৮৪৮ সালের একটি ছবি দেখলে বোঝা যায় গ্রাম কলকাতা কিভাবে একটু একটু করে শহরে পরিনত হয়ে উঠেছে৷ ছবিটির চিত্রকর স্যার চার্লস ডি অলি৷ ব্যস্ততম শহরের ভিড়ে তেমন ভাবে চার্চটি এখন আর নজরে পড়ে না৷ কিন্তু ওখানেই আছে পুরানো ধর্মতলার সঠিক চিত্র৷

ধর্মতলাকে এসপ্লানেড নামেও ডাকা হয়৷ বর্তমানে মেট্রো স্টেশনের নামও রাখা হয়েছে এসপ্লানেড৷ যদি ও শোনা যায় এই নামকরণটি ইংরেজদের করা৷

বাংলা তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য হরণকারি লর্ড ক্লাইভ এক ঐতিহাসিক চরিত্র। যিনি ছিলেন অতি ধূর্ত ও অসীম সাহসের অধিকার। 

১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব ইংরেজদের প্রতিহত করার জন্য কলকাতা আক্রমণ করেন৷ লর্ড ক্লাইভ এর প্রতিশোধ নেবার জন্য সুকৌশলে গুটি সাজাতে লাগলেন৷ কিন্তু তার সেই উদ্যেশ্য পূরণের জন্য এক লক্ষ টাকার প্রয়োজন পড়ল৷ সেই টাকা কিভাবে জোগাড় হবে সেই চিন্তায় মগ্ন ছিলেন৷ এমন সময় এক গুপ্তচর মারফৎ খবর পান তাঁর টাকার অভাব পূরণ করতে পারবে এক ছাতু বিক্রেতা (ভুজাওয়ালা)৷ যথারীতি তিন বছর সময় কালের মধ্যে টাকা পরিশোধ করার চুক্তি পত্রে সাক্ষর হল৷ সে সাক্ষর হল সাধারণ হ্যান্ডনোটে৷ সহজ সরল ভুজাওয়ালা তাই মেনে নিলেন৷ এদিকে তিন বছর অতিক্রান্ত হবার পরও লর্ড ক্লাইভ ছাতুওয়ালার টাকা পরিশোধ করলেন না৷ ইতি মধ্যে বাংলার ওপর দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে৷ ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার পরাজয় হয়েছে৷ টাকা পরিশোধের কথা বললেই ক্লাইভ সরল ছাতুবিক্রেতাকে ভয় দেখাতো৷ তুমি আমার কাছে এক লক্ষ টাকা পাও সে কথা অনেক লোকজন জানাজানি হয়ে গেছে৷ তোমার টাকা আমি পরিশোধ করে দিতে পারি কিন্তু দুর্বৃত্তরা তোমার টাকা হরণ করে তোমাকে খুন করে ফেলবে৷ সে কথা শুনে ভুজাওয়ালা বিশ্বাস করল এবং ভয় পেয়ে টাকাগুলি ক্লাইভের কাছে রেখে দিতে সন্মত হলেন৷ তার পরিবর্তে ওই এলাকায় একটি পুকুর বা তালাও খননের আবেদন জানালেন৷ ক্লাইভ ভুজাওয়ালার কথা মতো একটি বড়ো তালাও (পুকুর)খনন করে দেন৷ এতে এলাকা বাসির খাদ্য জলের অভাব পূরণ হয়৷ সেই থেকে লোক মুখে প্রচারিত হতে হতে জায়গাটির নাম ধর্মতালাও থেকে ক্রমশ "ধর্মতলা" হয়ে যায়৷ সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য আজও বহন করে চলেছে আজকের ব্যস্ততম তিলোত্তমা৷ লর্ড ক্লাইভ অনেক পরে পুকুরটি বন্ধ করে ওখানে একটি পার্ক নির্মাণ করেন৷ যার নাম রাখা হয় "লর্ড কার্জন পার্ক"৷ যা আজ 'কার্জন পার্ক' নামে বিশেষ পরিচিত৷ একদার ধর্মতালাও ( পুকুর ) পার্কে পরিনত হলেও  'ধর্মতলা' নামটি কিন্তু মুছে জায়নি৷ তবে ক্লাইভ নিজের নামে পার্কটির নামকরণ নাই বা করতে পারতেন৷ ভুজওয়ালার নামটি থাকলে অন্তত তার সরল বিশ্বাসকে একটু মর্যাদা দেওয়া হতো৷ অবশ্য এ নিয়ে কেউ কখনও প্রতিবাদ করার আবশ্যকতাও বোধহয় করেননি৷ করবেই বা কি করে? আমরা তখন ইংরেজ স্বাসনাধীনে নিজ দেশে পরাধীন নাগরিক৷ এই ভাবে কত না সত্য ইতিহাস কালের করাল গ্রাসে হারিয়ে যায়৷ তবে সাক্ষ্য হিসাবে থেকে যায় কিছু না কিছু স্মৃতিচিহ্ন। শুধু খুঁজে নেবার অপেক্ষাটুকু পড়ে থাকে আমাদের জন্য।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours