সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, শিলিগুড়ি:

দীপ্ত সূর্য অদ্য অস্তমিত। সন্ধ্যাকাল সমাগত।  গৌড়বঙ্গের প্রতি গৃহে অন্তঃপূরিকাগন প্রজ্জ্বলিত প্রদীপে  চন্দ্রকে আহ্বান করছেন।

 রাজধানী কর্ণসুবর্ণ আজ আলোকমালায় সুসজ্জিত। পূরবাসীরা আনন্দে উদ্বেল। কারণ জানতে হলে পিছিয়ে  যেতে হবে বেশ কয়েক শতাব্দী পূর্বে তৎকালীন  গৌরবজ্জ্বল গৌড়বঙ্গে।

 সময়টা ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ প্রান্ত। মহাপ্রতাপশালী গুপ্ত সাম্রাজ্যের  গৌরব সূর্য অস্তমিত প্রায়। 

মগধ মহাসামন্ত গৌড়েশ্বরশশাঙ্ক  দীর্ঘকাল পর প্রত্যাবর্তন করলেন রাজধানী কর্ণসুবর্ণে।  সুসজ্জিত নগরী। আনন্দে উদ্বেল নগরবাসী গৌড়াধিপের আগমনে।

উত্তরভারত রাজনীতির  অন্যতম ভাগ্যনিয়ন্ত্রক, দিগ্বিজয়ী স্বামীর ললাটে রাজতিলক এঁকে, মঙ্গলাচরণে বরণ করলেন রানী লক্ষীদেবী। শশাঙ্কের সাংসারিক  জীবনে লক্ষীদেবী প্রকৃত অর্থেই লক্ষীস্বরূপা। বিবাহ পরবর্তী জীবনে সাফল্যের চরম শিখরে উঠেছেন শশাঙ্ক এবং সেই  সাফল্য ক্রমবর্ধমান। 

বর্তমান রাজনীতির হালহকিকত এবং স্বামীর ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন দুটি সন্তানের জননী লক্ষীদেবী। আক্ষেপ শশাঙ্কে যোগ্য উত্তরসূরী উপহার দিতে পারেননি তিনি। একমাত্র পুত্র মানব, বলশালী  হলেও পিতার ন্যায় কুশলী রাজনীতিক নয়। বুদ্ধির স্থলে আবেগের গুরুত্ব অধিকতর তার কাছে।

শশাঙ্ক! বঙ্গজননীর অত্যাশ্চর্য প্রতিভাধর সন্তান। সামান্য অঙ্গরাজ্যধিপতি থেকে মাত্র চতুর্দশ বৎসরের মধ্যে অভূতপূর্ব উত্থানে উল্লেখযোগ্য ধাপ মগধ মহাসামন্ত পদ অলংকরণ।

মহাসামন্তই যে প্রকৃতপক্ষে শাসনকর্তা, অবহিত শাসক প্রজাবর্গ উভয়পক্ষই। 

সামান্য সামন্তরাজের উত্থান বলাবাহুল্য প্রতিবেশী নরপতিদের অধিকাংশের চক্ষুশূল। শশাঙ্ক এঁদের গুরুত্ব দেওয়া অবান্তর মনে করেন। নিজেকে নিয়ে অসন্তুষ্ট  বাহুবলী শৈবউপাসক শশাঙ্ক। সম্ভবত অসন্তুষ্টিই তাঁর সাফল্যের নেপথ্যে।

বঙ্গের  শষ্য শ্যামলা উর্বর প্রকৃতি শান্তিপ্রিয় বঙ্গবাসীকে রণবিমুখ করেছে, রণকৌশলী শশাঙ্ক এই মানসিকতার মূর্তিমান প্রতিবাদ। গৌড়ের নিকটস্থ প্রাগজ্যোতিষপুরে কর্তৃত্ব বিস্তারের পর, উত্তরভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু মগধাধিপতি মহাসেনগুপ্ত কর্তৃক যোগ্যতাবলে মহাসামন্ত পদপ্রাপ্তি। গুপ্তবংশের গরিমা তখন অস্তাচলে। মগধাধিপতির সহিত অতীত গৌরব হারাচ্ছে মগধ, অধুনা  উত্তরভারতীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্র কনৌজ। কনৌজেরাজ গ্রহবর্মনের সদাসতর্ক, সজাগদৃষ্টি  শশাঙ্ক ও তাঁর অধুনামিত্র মালবরাজ দেবগুপ্তের প্রতি।

শশাঙ্ক  দুর্দান্ত কূটনীতি ও রণনীতির সমন্বয়ে সমগ্র উত্তরভারতে স্বীয়  প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টায় প্রয়াসে প্রধান ভরসা, যুগোপযোগী রণনিপুণ সেনাবাহিনী! পদাতিক বাহিনী, দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী এবং হস্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত।

অকারণে যুদ্ধাভিলাষী নন গৌড়েশ্বর। বিরোধী রাজ্যের তরফে প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেই  ক্ষমতার আস্ফালন দেখান নতুবা শান্তিপূর্ন অধীনতা স্বীকারের অঙ্গীকার এবং বাৎসরিক সুনির্দিষ্ট রাজকর প্রদানে সন্তুষ্ট তিনি। সম্প্রতি যেমনটি  হয়েছে অযোধ্যা, কোশাম্বী ,শ্রাবস্তী, কুশীনগর, বারানসী, বৈশালী রাজ্যের ক্ষেত্রে। 

তবে তাঁর অশান্তির কারণ হয়েছে, থানেশ্বরে পুষ্যভুতিবংশের প্রভাকরবর্ধনের উত্থান। যদিও তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন তবে উপযুক্ত  দুই কুমার, রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধন যথেষ্টই সমরকুশলী। সম্প্রতি প্রভাকরবর্ধন মোক্ষমচাল চেলেছেন।  রাজকন্যা রাজ্যশ্রীর সাথে কনৌজরাজ গ্রহবর্মনের বিবাহের মাধ্যমে দুই শক্তিশালী রাজ্য আত্মীয়তার বন্ধনে  আবদ্ধ করে। অবশ্যম্ভাবী ফলাফল নিরঙ্কুশ ক্ষমতা বৃদ্ধি! শশাঙ্কের  নিদ্রাহীনতার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজ্যশ্রীর বিবাহের অব্যবহিত পরেই দীর্ঘকালীন রোগভোগের দরুণ পরলোকগমন করলেন প্রভাকরবর্ধন। সিংহাসনাসীন হলেন  জৈষ্ঠ্যকুমার রাজ্যবর্ধন। কৌশলী  শশাঙ্ক  মালবরাজ দেবগুপ্তর সাথে মিত্রতা স্থাপনের মাধ্যমে নিজের অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছবার পথ সুগম করলেন। 

তাঁরা একত্রে কনৌজ আক্রমণ করলেন। অতর্কিত আক্রমণে দেবগুপ্ত হস্তেপরাজিত ও নিহত হলেন গ্রহবর্মন। ভগ্নির আকস্মিক ভাগ্যবিপর্যয়ে স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ রাজ্যবর্ধন যুদ্ধযাত্রা করলেন। দেবগুপ্তকে হত্যা করে ভগ্নিপতি হত্যার প্রতিশোধ নিলেও, অনভিজ্ঞ রাজ্যবর্ধন পরাজিত ও নিহত হলেন শশাঙ্কের কূট ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে। হর্ষর বেতনভূক সভাকবি বানভট্টের লেখা ‘হর্ষচরিতে’ তেমনটি উল্লেখিত।  এমন কি তিনি শশাঙ্ককে ‘গৌড়াধম’ বলে ভর্ৎসনা করেছেন প্রতিটি ছত্রে।

হর্ষর রাজত্বকালে, রাজানুগ্রহিতা চৈনিক  পরিব্রাজক বৌদ্ধ হিউয়েন সাঙের রচনায় অনুরূপ বর্ণনা। বাস্তব রহস্যাবৃত, কারণ শশাঙ্ক ইতিহাসে উপেক্ষিত চরিত্র। শশাঙ্কের সম্পর্কে  যাবতীয় তথ্য মেলে তার শত্রুপক্ষের মদৎপুষ্ট  ঐতিহাসিকদের রচনাবলী থেকে। বলাবাহুল্য  একপেশে ইতিহাস। নইলে রাজ্যবর্ধনের অন্তিম যুদ্ধে ছলনার আশ্রয় নিয়েছেন, এমন অভিযোগেও অভিযুক্ত হলেন ষড়যন্ত্রের শিকার গৌড়েশ্বর।

আত্মহননে উদ্যত ভগ্নিকে উদ্ধার করে দেশে ফিরলেন সুযোগসন্ধানী হর্ষবর্ধন। রাজ্যভার  গ্রহণ করলেন থানেশ্বরের সাথে অবিভাবকহীন কনৌজেরও, ‘সকলউত্তরাপথনাথ’ উপাধি গ্রহন তখন কেবল উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা। জনগনের সহানুভূতির ঢেউ হর্ষবর্ধনকে ক্রমশ জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিচ্ছে। হতভাগ্য রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু রয়ে যায় রহস্যের অন্তরালে যুগযুগান্তর। 

বিজয়ী শশাঙ্ক স্বদেশে ফিরে এলেন। রাজতিলকে স্বামীকে বরণ করতে এই প্রথম  লক্ষীদেবী অনুপস্থিত। পত্নীর অসন্তোষের কারণ  অনুমান করতে বিলম্ব হল না বুদ্ধিমান নরপতির। সদ্যবিবাহিত গ্রহবর্মনের হত্যা, সর্বোপরি অন্যায় যুদ্ধে সন্তানসম রাজ্যবর্ধনের হত্যা সমর্থন করতে পারেননি রানী, গৌড়েশ্বরের আচরণ মর্মাহত করেছে তাঁকে। তাঁদের একমাত্র পুত্র মানবের সমবয়সী বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাজ্যবর্ধন বরাবরই চক্ষুশুল ছিলেন পরমশৈব শশাঙ্কের। তা বলে কৌশলে হত্যা! নৈব নৈব চ। শশাঙ্ক বীর! কাপুরুষের ন্যায় আচরণ তিনি প্রাণ থাকতে করবেন না। অর্ধাঙ্গিনী  হয়েও লক্ষীদেবী অনুধাবনে ব্যর্থ হলেন, গোপনে দীর্ঘশ্বাস মোচন করেন ইতিহাসের বিড়ম্বিত নায়ক শশাঙ্ক। 

তবে বৌদ্ধধর্মের উত্থান ও জনজীবনে এর প্রভাব নিতান্তই অসহ্য ছিল গৌড়েশ্বরের। তিনি সুযোগের সদব্যবহার করেছেন মাত্র। ইতিহাসে  লেখা রইলো এমনটিই। যদিও ইতিহাস এবং লক্ষীদেবী উভয়ই অজ্ঞাত রইলেন প্রকৃতসত্যের।

রানীর অসন্তুষ্টি বুঝেই কনৌজ আধিপত্য  বিস্তারে বিরত রইলেন শশাঙ্ক। দিগ্বিজয়ী বীর অন্দরমহলে পরাস্ত। নিরবতাই অস্ত্র রানীর। বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হলেন শশাঙ্ক। ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী রানী যেমন তাঁর নেপথ্যে শক্তি তেমন  যে কোনো অপকর্মের কঠোর সমালোচক পরামর্শদাত্রীও বটে।

লক্ষীদেবী বিচলিত প্রতিরাত্রে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছেন তিনি। আরাধ্য মহাদেব মিলিয়ে যাচ্ছেন তথাগত বুদ্ধমূর্তিতে। প্রাচীন শিবমন্দিরে গিয়ে দেখলেন অবিকল স্বপ্নদৃশ্য! বিল্ববৃক্ষের পরিবর্তে বোধিবৃক্ষতলে আসীন মহাদেবের ভঙ্গিমায় ভগবান তথাগতের করুণাঘন মূর্তি। এ কোন ইঙ্গিত!  

বৌদ্ধধর্ম বিদ্বেষী স্বামীকে সাশ্রুনয়নে অকপটে নিবেদন করলেন, স্বপ্ন এবং বাস্তবের সাথে তার অভূতপূর্ব সামঞ্জস্যতা! রানীর কাতর প্রার্থনায় নিরাপরাধ বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচার বন্ধে সন্মত হলেন শশাঙ্ক। 

প্রৌঢ় হয়েছেন শশাঙ্ক, বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে পূর্বের ন্যায় যুদ্ধোন্মাদনা হ্রাস পেয়েছে। ইদানিং শারীরিক দৌর্বল্য অনুভব করেন। মুখবিবরে  বিষময় ক্ষত নিরাময়ের পরিবর্তে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রাজনীতি বিষমবস্তু! নিজের শারীরিক - মানসিক দৌর্বল্য প্রকাশ করে শত্রুপক্ষের  উৎসাহ বৃদ্ধিতে নারাজ তিনি। সুস্থতার অভিনয়  চালিয়ে যাচ্ছেন তীব্র যন্ত্রণা গোপন করে। 

প্রদীপ চিরতরে নেভার আগে প্রজ্জোলিত হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কঙ্গোদ অভিযানে কঙ্গোদরাজের ঔদ্ধত্যের সমুচিত জবাব।  থানেশ্বরের সাথেও শান্তিপূর্ণ- সহাবস্থান নীতি গ্রহণ। রাজ্যবিস্তারে আগ্রহ নেই শশাঙ্কের।  বিচক্ষন, দূরদর্শী গৌড়েশ্বর অনুমান করেছেন তাঁর সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায়, রাজপুত্র মানব পিতার সুবিশাল সাম্রাজ্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী নন, স্বভাবতই  উদাসীনতা গ্রাস করছে ক্রমশ।   দুরারোগ্য রোগের প্রকোপ ক্রমবর্ধমান , মুখবিবরে একাধিক ক্ষতের অসহনীয়  প্রদাহ শয্যাশায়ী করেছে মহাপরাক্রমশালী শশাঙ্ককে। লক্ষীদেবী স্বামী সেবায় নিয়োজিতপ্রাণা।

অভিশাপ! বোধিবৃক্ষ উৎপাটন, নিরীহ বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচারের ফল! অথচ হর্ষবর্ধনের বেতনভুক সভাকবি বানভট্ট অথবা মিত্র  পরিব্রাজক  হিউয়েন সাঙ এড়িয়ে যাবেন প্রকৃতসত্য! অপবাদদুষ্ট হবেন শশাঙ্ক। 

শৈশবে শশাঙ্কের স্বহস্ত নির্মিত শিবলিঙ্গ ভেঙে দিয়েছিলেন এক উদ্ধতস্বভাব বৌদ্ধ। বৌদ্ধবিদ্বেষের বীজবপন তখনই, পরবর্তী কালে যা বিষবৃক্ষের আকার নিয়েছিল, ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে প্রকৃত তথ্য। 

যন্ত্রণাকাতর শশাঙ্ক  শেষরাত্রে নিদ্রামগ্ন হয়েছেন। লক্ষীদেবী নিত্যপূজা সমাপনান্তে ইষ্টদেবতার চরণামৃত পান করাতে এসে, শয্যায় নিশ্চল, নিস্পন্দ স্বামীকে দেখে হাহাকার করে উঠলেন। 

বহুদিন পর রোগক্লিষ্ট গৌড়েশ্বরের মুখে পরমপ্রশান্তি! ওষ্ঠে স্মিত হাসি! ক্ষমাসুন্দর তথাগত, তাঁর সব অপরাধ ক্ষমা করে, ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন।  

শশাঙ্ক চলে গেলেন বাংলার গৌরব সূর্য অস্তমিত হল চিরকালের মতো। ইতিহাসে উপেক্ষিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত নায়ক। আপন ক্ষুরধার বুদ্ধি ও বাহুবলে অর্জিত রাজ্যপাট সুযোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে ধূলিস্যাৎ হয় স্বল্প সময়ের মধ্যেই।



 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours