সুস্মিতা পাল, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কলকাতা:

'কণিকা' - সংক্ষিপ্ত ছন্দে গাঁথা কিছু পংক্তি, রবীন্দ্রনাথের এই সৃষ্টির সাহিত্যিক মূল্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যকরী ভূমিকা আছে। যতদিন পাঠক্রমে ভাবসম্প্রসারণ নামে ভাবগম্ভীর বিষয়টির অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন এই অণুকবিতাগুলি ব্যাপকভাবে আলোচিত হবে। বাংলাভাষা থেকে বর্তমান প্রজন্মের বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই যেভাবে দূরত্ব বজায় রাখতে ব্যস্ত, তাতে উৎসাহী ও অনুরাগী পাঠক ছাড়া আর কতজনের কাছে 'কণিকা ' কণামাত্রও আদর পাবে, তা তর্কসাপেক্ষ। 

''রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা /সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা।''

নিজে যেমন স্কুলজীবনে লিখেছি, ছাত্রছাত্রীদেরও পড়াতে গিয়ে বহুবার বলেছি পংক্তিদুটি। যা চলে গেছে তার জন্য দুঃখ বা অনুতাপ করে বৃথা সময় নষ্ট করলে বর্তমানের আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হতে হয় - এটিই এর মূল বক্তব্য। যদিও দুঃখ বা অনুতাপ সম্পূর্ণ পরিপূরক নয় একে অপরের। দুঃখের অনুভূতিতে কৃতকর্মের অস্তিত্ব থাকে না সবসময়, যদিও অনুতাপ করে মানুষ, ভাবে যে হয়তো এমনটা না করলে বা করলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেতো। আর অবিমিশ্র অনুতাপে সোচ্চার থাকে না যে অনুভব সেটা হলো - অহং বা আত্মকর্মের প্রতি বিবেক দংশন। 

মিঃ শাসমলকে মনে পড়ে? ব্যবসার অংশীদার অধীর চক্রবর্তীকে পরিকল্পনা করে খুন করে উত্তর বিহারের এক নির্জন ফরেস্ট বাংলোতে আত্মগোপন করে থাকতে আসেন। নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, কেউ নাগাল পাবে না। কিন্তু বিরক্তি বাড়াতে প্রথমে কুকুর, তারপর ডোরাকাটা বিড়াল, শেষে গোখরো আসে ঘরের দখল নিতে। বিরক্তির জায়গায় চেপে বসে ভয়। দমবন্ধ করা আবহে মিঃ শাসমলের মনে জেগে উঠল ছোটবেলা থেকে তার নিজের হাতে ঘটানো একের পর হত্যার স্মৃতি। অপরাধবোধ করাঘাত করতে থাকল অবচেতন মনের বন্ধ দরজায়। 

'জীবনে যত প্রাণী হত্যা করেছেন তিনি তার সবগুলোই কি আজ এই ঘরে এসে হাজির হবে নাকি? 'এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই শেষ অতিথি এল ঘরে - 'দরজা খোল জয়ন্ত। আমি অধীর। দরজা খোল।' ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলেন মিঃ জয়ন্ত শাসমল যে তারা সবাই এগিয়ে আসছে। পরদিন সকালে কলকাতা থেকে পুলিস এসে হার্ট অ্যাটাকে মৃত মিঃ শাসমলকে দরজা ভেঙ্গে আবিষ্কার করে। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার, ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে পুলিসকে নিয়ে আসেন অধীরবাবু স্বয়ং। মিঃ শাসমল তাকে গুলি করার মূহুর্তে লোডশেডিং হয়ে যাওয়ায় গুলি সোফায় লেগে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, প্রাণে বেঁচে যান অধীরবাবু। আইনের শাস্তির চেয়েও মারাত্মক অপরাধবোধ ও অনুতাপের আঘাত। সত্যজিত রায়ের কলমে 'মিঃ শাসমলের শেষ রাত্রি' মনে রাখার মতো এক গল্প। 

কয়েকদিন আগে টেলিভিশনে প্রথম সারির এক বাংলা নিউজ চ্যানেলের একটি খবর গল্পটির কথাই নতুন করে মনে করালো। ২০১৪ সালে বড় ভাইকে খুন করে বাড়িতেই পুঁতে দিয়েছিল ছোট দুই ভাই। এতদিন পরে অনুতাপ হওয়ায় তারা স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। সাময়িক উত্তেজনার বশে বা হয়তো পরিকল্পনা করেই দাদাকে হত্যা করেছিল তারা, ঠান্ডা মাথায় মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল মৃতদেহ। প্রচার করেছিল দাদা নিঁখোজ হয়ে গেছে। ভদ্র নির্বিরোধী পরিবারটিকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করেনি কেউ। কে জানে, কেন তারা এতদিন পরে স্বীকার করল অপরাধ? 

হয়তো, এই দীর্ঘ ছয় বছর প্রতিটি দিন তারা কাঁটার পথে হেঁটে রক্তাক্ত হয়েছে, সন্ধ্যাতারার আলোয় তুলসীমঞ্চের পাশে দাদার ছায়াকে অপেক্ষা করতে দেখেছে। খাওয়ার টেবিলে তাদের পাশের চেয়ারে দাদার শুকনো মুখ ভরপেট খেতেও দেয়নি। প্রকাশের লজ্জা ত্যাগ করে পাপ উন্মুক্ত করেছে নিজেকে। তারপর অনুতাপের আগুণে পুড়তে পুড়তে বাকি জীবন গরাদের আড়ালে বেঁচে থেকে জীবনের বিদ্রূপ সহ্য করতে হবে। জীবন মরণের সীমানার অপর পার থেকে মৃত মানুষটি হয়তো দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যক্ষ করছিলেন তার স্নেহের অনুজদের - যারা এতদিন প্রতিটি পল বেঁচে থেকেও একটু একটু করে ফুরিয়ে যাচ্ছিল। 



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours