সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

বিশ্বাস শব্দটি বড়ই অদ্ভুত তাই না? এটি অর্জন করতে কিন্তু বহু সময় লাগে। কিন্তু ভাঙতে? ভাঙতে, এক মুহূর্তও সময় লাগে না, কি বলেন? আসলে কোন কিছুকে বিশ্বাস করা বা না করা, বা কারো কাছে বিশ্বাসী হয়ে ওঠা, এই দুটো কাজই কিন্তু খুব একটা সহজ কাজ নয়। কেউ যেমন বিশ্বাসী তার ধর্মে তো কেউ আবার বিশ্বাসী তার নিজ কর্মে। আর মানুষ মাত্রই তো তার এই ধর্ম-কর্মকে নিয়েই থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?

জীবনে চলার পথে আমরা প্রত্যেকেই ভগবানের উপর বিশ্বাসী। তাই নিজের কর্মের থেকেও ভগবানের উপর বিশ্বাসটা আমাদের অগাধ। যেমন ধরুন কোন ছাত্র তার পঠনপাঠনের দিকে যতটা না মন দেয় তার থেকে বেশি মন দেয় অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের প্রতি। তাদের এই বিষয়টি আপনারা বেশি করে লক্ষ্য করবেন, যখন তারা কোন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়। এতে অবশ্য তাদেরকে দোষ দিয়ে কোন  লাভ নেই। আসল দোষী তো আমরা নিজেরাই। আমরা মা-বাবারা ছোট বেলা থেকেই তাদের মনে একটা অন্ধবিশ্বাস বা ভয় প্রসন করে আসছি। তাদের পরীক্ষার ভালো ফলের আশায় আমরাই তো তাদের কপালে দই আর হলুদের ফোঁটা এঁকে দি। শুধু তাই নয়, এই সময় কেউ যদি আমাদের কিছু বলে আমরা মা-বাবারা তো তাই করি। কেউ যদি বলে অমুক জায়গায় যাও, দেখবে সেখানে একটা গাছে সুতো দিয়ে ঢিল বাঁধা আছে ওখানে তুমিও একটা ঢিল বেঁধে এসো দেখবে তোমার সব মনোস্কামনা পূর্ণ হবে। অমনি আমরাও আগেপিছে না ভেবে ছুটি সেখানে ঢিল বাঁধতে। এতে অবশ্য কার কতটা উপকার হয় বা হয়েছে তা আমি জানি না। তবে আমার যে হয় নি তা আমি আপনাদেরকে গ্যারান্টি সহকারে বলতে পারি। 

মানুষের অন্ধবিশ্বাস সত্যিই বড়ো অদ্ভুত। তা না হলে কি আমরা এখনো হাওড়া ব্রিজের উপরে দাড়িয়ে গঙ্গা বক্ষে পয়সা ছুঁড়ে ফেলতে দেখি! না জানি এভাবে মানুষের কতো পয়সাই না নষ্ট হয়েছে আর কতো পয়সাই না নদীবক্ষে জমা হয়েছে। আবার কিছু কিছু মন্দিরে গেলে আপনারা আমার মতোই দেখতে পাবেন মন্দিরের ঠিক পাশে কোন না কোন এক গাছে সুতো দিয়ে ঢিল বাঁধা আছে। আমি তো এমনও শুনেছি যে মনোস্কামনা পূর্ণ হলে নাকি সেখানে গিয়ে ওই বাঁধা ঢিল খুলে আসতে হয়। ভাবুন তো কতটা কঠিন আর অযৌক্তিক কাজ এটা। এটা কি কারো পক্ষে সম্ভব? সে কিছু বছর পরে গিয়ে নিজের লাগানো ঢিল খুঁজে বের করে তাকে খুলে আসা। ব্যাপারটা অনেকটা হাস্যকর বলে মনে হয় না কি আপনাদের?

মানুষের এই অন্ধবিশ্বাস নিয়ে আপনাদের আর একটা কথা বলি। এটা যে শুধু আমাদের ভারতবর্ষেই হয় তা কিন্তু নয়। বিশ্বের এমন অনেক জায়গা আছে যেখানকার মানুষরাও এই অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী।

এমনই একটা জায়গা সম্পর্কে আজ আমরা কিছু কথা জানি। এই জায়গাটি আসলে স্কটল্যান্ডে। স্কটল্যান্ডের পিক জেলার জঙ্গলে একটি গাছ আছে যে গাছটি 'অর্থগাছ' নামে পরিচিত। বিদেশি পর্যটকদের কাছে এই জায়গাটি এখন আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু বলা চলে। প্রায় ১৭০০ বছর পুরনো এই গাছ পুরোটাই মুদ্রা দিয়ে আচ্ছাদিত। কেউ কেউ এই অর্থ বা টাকার গাছকে ভূতুরে গাছ বলেন, আবার কেউ দাবি করেন এই গাছে নাকি দেবতার বাস। আর এই বিশ্বাসেই বহু পর্যটক এই গাছটির পাশে রাখা পাথর দিয়ে কয়েন গেঁথে দেন এই গাছটির কাণ্ডে। তাই এই গাছটিতে অনেক বিদেশি মুদ্রাও দেখা যায়। কেউ কেউ আবার এই গাছটিকে পুজো করেন। এখানকার মানুষ এই গাছটিকে পবিত্র গাছ বলে মনে করেন।

যবে থেকে মানুষ এই আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের বিকাশ করেছে, তবে থেকেই তারা প্রকৃতির আত্মার কাছে যেন নৈবেদ্য উৎসর্গ করে চলেছে। কেউ একবারও ভাবে নি যে গাছের গায়ে কয়েন গেঁথে গাছটিকে কতোটা অসুস্থ করে তুলেছে, নিজেদের শারীরিক সুস্থতার কথা ভেবে। শোনা যায় কেউই নাকি এই গাছ থেকে কয়েন খুলে নিয়ে যাওয়ার সাহস দেখায় নি। তাদের বিশ্বাস ওই মুদ্রা খুলে নিলে নাকি তারা অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে যাবে। আচ্ছা ভাবুন তো এই সব মুদ্রা কি কখনো কোন ব্যক্তির রোগ সারাতে সক্ষম বলে মনে হয় আপনাদের? এটা কি সত্যিই রোগ তাড়ানোর টোটকা নাকি সবটাই নাটকীয়? এমন তো হতেই পারে এই মুদ্রা দিয়ে নীরবে ইচ্ছে পূরণের আশা রাখে কেউ, আবার এও হতে পারে, এই মুদ্রা গুলো দিয়ে তার পূর্ববর্তী মালিকদের অস্তিত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যেই এই প্রচলন শুরু হয়েছিল।

ওয়েলসের গুইয়নেডে ছুটির আকর্ষণের ব্যবস্থাপক তার মালিকের সম্পত্তির উপর মুদ্রা দিয়ে একটি ফয়েল ট্রাঙ্ক শোভিত করার পরেই এই মুদ্রা গাছটির ঘটনা নিয়ে নিজে গবেষণা করেছিলেন। তিনি দাবি করেন তার এই অনুশীলনটি ১৮ তম শতাব্দীতে শেষ হয়েছিল। বর্তমানে এই মুদ্রা গাছ গুলো দেখতে অনেকটা আকর্ষণীয় ছত্রাক বা ধ্বংসাত্মক পরজীবী বলে মনে হয়।

ছোট বেলায় মা-বাবা কোন কিছু শখ করে কিনে দেওয়ার পর তা যদি নষ্ট করে দিতাম তখন মা-বাবা রেগে গিয়ে বলতেন 'জিনিসের প্রতি যত্নশীল হতে পারো না, আমার টাকা কি গাছে ফলে? যে তুমি নষ্ট করবে আর আমি কিনে এনে দেবো' । সত্যি বিশ্বাস করুন, আজ এই কথাগুলোই আমি আমার ছেলে মেয়েদের বলি।

সত্যি..., সত্যি সত্যিই যদি গাছে টাকা ফলত তা হলে মন্দ হতো না কি বলুন...? অন্তত, স্কটল্যান্ডের টাকার গাছের কথা শুনে আমার তো তাই-ই মনে হয়।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours