দেবস্মিতা ধর, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

ভোর হচ্ছে। এ ভোরের প্রকাশ অন্য। এ ভোরের গহীনে কান‌ পাতলে মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যায়। 

মহালয়া আদপেই কি? 

একটি তিথি? একটি কাল? একটি পক্ষ? 

সন্ধি বিচ্ছেদের পানে চোখ রাখলে দেখব, 'মহান+আলয়'। 'আলয়' তো গৃহ। ঘর। ফেরার ঠিকানা। কোথায় ফেরা? কারা ফেরেন এই বিশেষ তিথিতে? চোখ বন্ধ করে ফেলি। মেঘের মতো কল্পনায় ভেসে আসে। অনুভব করি, অন্ধকারের লয় আর আলোর ধী-গতিতে মহাদ্ভাসন। আমি সেই আলোর নন্দিত ছন্দের মধ্যে অবগাহন করি। তাঁদের প্রত্যক্ষ করি সেইসব আলোর যাত্রীদের যাঁরা এই পার্থিবলোকের ধরাছোঁয়ার বাইরে যাত্রা করেছেন অনন্তলোকে। কায়াহীন শরীরে তাঁদের আকুল আগমন ঘটে আজকের জীবন-মৃত্যুর‌ সীমান্তের এই মহাসন্ধিক্ষণে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন আমার চেনা-অচেনা আপনজনেরা‌। আমি যেন অনুভব করি তাঁদের ছায়া ছায়া বিদেহী অস্তিত্ব উপনিষদের আত্মার অবিনশ্বরতার ভাষ্যে ঘোষণা করছে - "আমরা কিন্তু আগেও ছিলাম। তাই পরেও আছি"।  বহু আগে পঠিত কিছু শব্দ স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে -

'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব

থেকে যায়, অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে 

আরো ভালো-আরো স্থির দিকনির্ণয়ের মতো চেতনার 

পরিমাপে নিয়ন্ত্রিত কাজ

কতদূর অগ্রসর হয়ে গেল জেনে নিতে আসে।'

'ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যান্ত‌ ভুবনত্রয়ম, 

আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্তং তৃপ্যন্ত'- এই মন্ত্র উচ্চারণ করেই লঙ্কাবিজয়ের পূর্বে এই তিথিতে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে গণ্ডুষ প্রমাণ জল নিবেদন করেছিলেন কিনা জানিনা, তবে‌ এটা ভাবলে মনটা অচিরেই প্রসন্ন হয়ে ওঠে, যে এই মন্ত্রে নিবেদন শুধুমাত্র রক্তের আত্মীয়তার গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকে না। প্রিয়র ব্যাপ্তি সশ্রদ্ধ নিবেদনের সৌরভে সুবিস্তৃত হয়ে ওঠে। এক একান্নবর্তী পরিবারের যোগ হয় যেন এই তিথিতে।

একান্নবর্তী পরিবার। মনে হওয়া মাত্র বুকের ভেতর থেকে একটা বেদনাদীর্ণ দীর্ঘশ্বাস বের‌ হয়ে আসে পবিত্ররঞ্জনবাবুর। অম্লানপুরের সুবিশাল বাড়িটা বাবা প্রদ্যুন্নরঞ্জন অনেক স্বপ্ন নিয়ে বানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের আট ভাইয়ের আর একসাথে থাকা হল না। আজ তো অনেকেই নেইও আর। স্বপ্ন কি তিনিও দেখেননি! রিটায়ার করার‌ আগে থেকেই তো বালিগঞ্জে এই একচিলতে বাড়িটা একটু একটু করে বানানো শুরু। স্ত্রী, সুযোগ্য পুত্র, নাতি-নাতনি নিয়ে শেষ কটাদিন আবার ও বোধহয় সেই হারিয়ে যাওয়া একান্নবর্তীর‌ স্বাদটা পেতে চেয়েছিলেন। একটা খবর। মাত্র একটা খবর সব শেষ করে দিলো। মহালয়ার সদ্য ফোটা আবছা ভোরের আলোয় বারান্দায় ইজিচেয়ারটায় শুয়ে আবার আবার ও স্মৃতি দ্বারা রক্তাক্ত হচ্ছিলেন পবিত্ররঞ্জনবাবু। সেদিনও ছিল মহালয়া। দীপু, নামকরা সংবাদপত্রের সাংবাদিক ২৬ বছরের দীপ্তাংশু চ্যাটার্জী মহালয়ায় গঙ্গার ঘাটে তর্পণ-এর স্টোরি কভার করতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছিল জীবনের উচ্ছল সমুদ্র থেকে।‌ স্ত্রী আশা সেই শোক সামলাতে না পেরে আজও মানসিক ভারসাম্যহীন। পবিত্ররঞ্জনবাবুকে ৫ বছর ধরে একমাত্র ছেলে‌ হারানোর পরেও জীবনের এই দুরহ ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হচ্ছে। কিন্তু আর কত? দুটো‌ হাত জোর করে ছেলেমানুষের মতো ডুকরে কেঁদে ওঠেন পবিত্ররঞ্জনবাবু - "আর তো‌ সইতে পারিনা রে মা!"

পুরাণমতে মহালয়ার এই পুণ্যতিথিতেই, দেবী মহামায়া দেবতাদের কাছ থেকে অসুরবধের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দুগ্গা এসব ছোট্টবেলায় তাদের গ্রামের বাড়ির মাটির দাওয়ায় ঠাকুমার কোলে বসে চোখ বড়ো বড়ো করে শুনত। সোনাগাছির এই একচিলতে বাড়ির মধ্যে গাদাগাদির জীবনে ওসব যেন কোন জন্মের কথা মনে হয়। 

"কই রে অলপ্পেয়ে মাগী! এখনও যাসনি? এরপর কি তোর নাঙ নেমন্তন্ন করে নিয়ে যাবে?" মাসির বাজখাঁই আওয়াজে সম্বিৎ ফিরলো দুগ্গার। হাতে মাটিভর্ত্তি প্লাস্টিকটা শক্ত করে চেপে ধরে পায়ে পায়ে এগলো দুগ্গা। 

তিনকড়ি নস্কর লেনের এই ক্লাবের মূর্তি ক্লাবেই গড়া হয়। ছেলেরা গড়ার জন্য মাটি তাদের উঠোন থেকে আগেই নিয়ে গেছে, তবু মহালয়ার দিন ভোরে আরও কিছু মাটি কেন নিয়ে যেতে হবে দুগ্গা তা ঠিক জানে না। তবে ওর ওপর এই দায়িত্ব বর্তাবার কারণ ওর বাপ-ঠাকুদ্দার পদবি। দুগ্গা বামুন। হাসিও পায়। বেশ্যাদের ও তাহলে জাতপাত হয়! ক্লাব চত্বরে এসে দেখলো তোরজোড় বেশ পুরোদমেই চলছে। সেক্রেটারী বাঁকিদা ওকে দেখে এগিয়ে এল - "এসেছিস? যা ওখানে গিয়ে রাখ। আর শোন, ভুলেও কিন্তু মা-কে ছুঁয়ে ফেলিস না!" 

ক্লাবের ভেতরকার ঘরে কাজ হচ্ছে। আচ্ছাদনে ঢাকা মায়ের মুখ কেমন ম্লান মনে হয় দুগ্গার। আজ চক্ষুদান। কিন্তু পতিতা দুগ্গার তা চর্ম চোখে দেখার অনুমতি নেই। স্পর্ধা নেই একটিবার মায়ের চরণ ছোঁয়ার।‌ কেন? 'আমি কি তোর সন্তান নই মা?' সজল দীর্ঘশ্বাস উষালগ্নের ধূপ-ধুনোর গন্ধমিশ্রিত বাতাসকে ভারী করে তোলে।

গোঁড়া ব্রাহ্মণ বারিকরতন বাঁড়ুয্যে আচারনিষ্ঠা পালনের জন্য নিজ অঞ্চলে বেশ‌ বিখ্যাত সমীহ উদ্রেককারী ব্যাক্তিত্ব। প্রতি মহালয়ার পবিত্র তিথিতে স্বর্গস্থ পূর্বপুরুষদের জলপ্রদানজাত তর্পণ নামক পুণ্য কর্মের জন্য তাঁর গঙ্গার ঘাটে আসা বাঁধা। 

এবারেই যা একটু দেরী হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করছিলেন বারিকরতন বাঁড়ুয্যে। আপদের ভিড়ও হয়েছে তেমনি। পরনের কাপড়চোপড়, জিনিসপত্র ধরার জন্য এবার কাউকে যোগাড় করতে হবে। ওই তো একটা ছোঁড়া দাঁড়িয়ে আছে জলের সামনে। "এই ছোঁড়া, এদিকে আয়, আমার জিনিসগুলো ধরতে হবে। কত নিবি?, বেশি হাঁকবি না কিন্তু"! 

- "না না, কিছু লাগবে না। এমনিই ধরব।"

- "অ। তা ভালো, এদিকে আয়। এগুলো বুঝে নে.." থমকে গেলেন বারিকরতন বাঁড়ুয্যে। চোখ কুঁচকে সামনে দাঁড়ানো‌ সুপুরুষ যুবকটিকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।‌ "তোর নাম কি রে ছোঁড়া?" একটু ইতস্তত জবাব এল, "আজ্ঞে, মনসুর, মনসুর আলি"। বারিকরতন বাঁড়ুয্যে ভিড়মি খেতে খেতে সিঁড়ি ধরে কোনওমতে সামলে নিলেন নিজেকে, অ্যাঁ! ছোকরা বলে কি? তাঁর এতদিনের আচারনিষ্ঠা, নিয়ম-কানুন দ্বারা সঞ্চিত পুণ্য যে পাপে ডুবে যাবে? তাঁর চোদ্দ পুরুষের উদ্দেশ্যে জলদান করতে এসে কিনা এই ম্লেচ্ছ  মুসলমানটার সাহায্য নিতে গেছিলেন? হরি! হরি! "মুখপোড়া, ম্লেচ্ছ, আমার জাত মারবার তাল তোমার?", এক্ষুণি বেরোও এখান থেকে, নইলে এমন হাটুরে মার খাওয়াব, এ জন্মে ভুলবি না।" 

কালো মুখে কোলাহল থেকে সরে এল মনসুর। সত্যিই তো, আজকের দিনে হিন্দুদের এই উৎসবে তার ঘাটে আসার তো কোনও প্রয়োজন নেই। আম্মি কত বারণ করে, তবু সে আসে। গঙ্গার মাঝে এই বিশেষ তিথিকে ঘিরে অগণিত মানুষের প্লাবন তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানে। সে কখনও হজে যায়নি। তবে শুনেছে, সেখানেও জনজোয়ার হয়। আচ্ছা, ধর্মীয় আচারে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু আচার পালনকারী মানুষের মধ্যে তো‌‌ কোনও ফারাক পায় না সে। শ্রদ্ধা, সমর্পণের কি সত্যিই কোনও ধর্ম হয়? আর কতদিন এই বৈষম্য? গঙ্গার স্নিগ্ধ বাতাসে মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে ঘৃণার বমন যেন আরও মিশকালো করে তোলে পতিতদ্ধারিণী গঙ্গাকে। 

   একটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায়, ঠিক এই সময়টাতেই গড়ের মাঠের দিক থেকে একটা অন্যরকম হাওয়া দেয়। খুশী মহম্মদ প্রতিবছরই বুঝতে চেষ্টা করে এই বাতাসে ঠিক কি অন্যরকম আছে?

রেকর্ডিং রুমে সবাই মোটামুটি এসে গেছেন। পঙ্কজদা যথারীতি গম্ভীর মুখে কোরাসের অগ্রে। কিন্তু...সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় খুশী মহম্মদ। এ তার চেনা। কিন্তু আজকের ভোরে এই পদধ্বনির ওজন যেন বড়ো বেশি মনে হয় তার। রুমে প্রবেশ করলেন তিনি। সদ্য স্নান সেরে এসেছেন। হাওয়াটা আবার অনুভব করলো খুশী মহম্মদ। হাল্কা গুঞ্জন উঠলো - 'এসে গেছেন'। গরদের ধুতি-পাঞ্জাবির জোড় তাঁর ঔজ্জ্বল্যের কাছে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। শরীরটাই যেন শুধু আকাশবাণী ভবনের রেকর্ডিং রুমে। মন‌ কোন অমৃত গন্ধর্বলোকের মন্দির প্রাঙ্গণে ধাবমান। অন্তর্মুখীন আয়ত দৃষ্টি সেই মন্দির বেদীতলে নিবদ্ধ। সুনিবিড় গাম্ভীর্য ঘন হয়ে আছে মুখপটে। একদৃষ্টিতে তাঁর পানে তাকিয়ে ছিলেন পঙ্কজকুমার। অব্রাহ্মণকে দিয়ে এমন‌ ব্রাহ্মমুহুর্তে চণ্ডীপাঠ! যন্ত্রীদের মাঝে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন তিনি। খুশী মহম্মদ, আলি, মুন্সীদের মধ্যে কোনও ফারাক করতে পারলেন না। কত ঝড় সামলাতে হয়েছে এই অনুষ্ঠানের জন্য। শেষ পর্যন্ত পেরেছেন। পেরেছেন এমন এক অর্ঘ্যমাল্য তৈরি করতে যা হবে কালোত্তীর্ণ। 

- "শুরু করছি তাহলে", গলা খাঁকরে বললেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। রেকর্ডিং মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন বীরূপাক্ষ। সারাটা জীবন‌ ঈশ্বরের সামনে একটাও ধূপ না জ্বালা মানুষটি তাঁর পূজায় ধ্যানস্থ হলেন। 

'ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ । 

ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা ।।'

ইথার তরঙ্গকারে তাঁর অপার্থিব শব্দরাজি কলকাতা, কর্ণাটক, কানসাস হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আরও আরও দূরে, হয়ত এই ভূলোকের পেঁজা তুলোটে আকাশের সীমানা পেরিয়ে ব্রহ্মাণ্ড মহাকাশ মাঝে শিউলিপ্রভায় ভাস্বরিত হচ্ছে। 

সপ্তঅশ্বের রথসারথী হয়ে অরুণ উদিতচ্ছটা থেকে মাঠের সেই অজানা বুনো গুল্ম। সবাই আজকের এই ভোরে ঐশ্বরিক দ্যুতিমাখা। 

পবিত্ররঞ্জনবাবু, দুগ্গা, মনসুর, তুমি, আমি, আমাদের সকলের অনুচ্চারিত মন্ত্র সম্পূর্ণ হচ্ছে ওই কণ্ঠে -

'সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনী ।

গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোঽস্তু তে ।। 

আমি এবার চোখ খুলি। প্রভাত নরম কাশের পরশে নুইয়ে দেয়। মনে হয়, বিশ্বচরাচর যেন হাসছে। আর বিশ্ববীণার ঝংকারে হাসছেন বিশ্বচরাচর ব্যাপ্তিময়ী মহালক্ষী মহামায়া। 

মনে হয়, আমাদের কত অযুত অপ্রাপ্তির কালান্তক বেদনা, কত অপমান, লাঞ্জনার রক্ত-অশ্রু, কত কল্পের অসহনীয় যন্ত্রণা আপন হৃদয়ে ধারণ করেছেন পূজারী। তাই তাঁর স্ত্রোত্রপাঠ অশ্রুভারে অমূল্য হয়ে উঠছে - 

'বিশ্বেশ্বরি ত্বং পরিপাসি বিশ্বম্‌

        বিস্বাত্মিকা ধারয়সীতি বিশ্বম্‌ ।

বিশ্বেশবন্দ্যা ভবতী ভবন্তি

        বিশ্বাশ্রয়া যে ত্বয়ি ভক্তিনম্রাঃ ।। '

ত্রিগুণাতীতা কল্যাণময়ী জগতমাতা যেন সকলের অলক্ষ্যে প্রত্যক্ষ করছেন, আমাদের সকলের অসমাপ্ত পূজার নিবেদন মহালয়ার এই মহাতাপসলগ্নে শ্রীবীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে শারদঅর্ঘ্য হয়ে তাঁর রাতুল চরণে ঝরে পড়ছে.......।

আধ্যাত্মিকতার যে স্তরে আমরা বিচরণ করি, করতে পারি, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণী কুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক তাঁর অনেক অনেক উচ্চ স্তরে অবস্থান করেন বলে মনে হয়। তাই তো ঈশ্বরের এই আরাধনায় তাঁরা স্বয়ং আমাদের কাছে হয়ে ওঠেন ঈশ্বর।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours