সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত, লেখিকা ও দূরদর্শন সঞ্চালিকা, কলকাতা:

(কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর আজ তিরোধান দিবস। এই পূণ্য লগ্নে কবি কন্যার মেয়ে অর্থাৎ নাতনি সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত কলমে কবির স্মৃতিচারণা দ্য অফনিউজ'এর জন্য) 

যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তকে বেশিরভাগ সমালোচক “দুঃখবাদী কবি” হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তবে কবি নিজেকে বলেছেন “মরুকবি”, বলেছেন “ দুখবাদী বৈরাগী”। যে আত্ম-প্রবঞ্চক, অফলা অস্তিত্বের চারদিক ঘিরে অজস্র মিথ্যার রঙিন বেসাতি, সেই মরুপ্রতিম অস্তিত্বের যন্ত্রণাবিদ্ধ এই কবি বারবার যে কথাটা শোনাতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে অপরাজিত মৃত্যুঞ্জয় মানুষের গান – ‘শুনহ মানুষ ভাই সবার উপরে মানুষ সত্য স্রষ্টা আছে বা নাই’। নিজের ‘দুঃখবাদ’ নিয়ে কবি ঠাট্টা করেছেন “ বাল্যের ম্যালেরিয়া কুইনাইন দ্বারা অবদমিত হয়ে পরিণত বয়েসে কাব্যরূপ গ্রহণ করেছে”। যতীন্দ্রনাথের অনেক কবিতাই দুঃখ-উপলব্ধির নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও তাঁর কবিতা প্রচলিত-কাব্য ভাবনায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মানুষ সম্পর্কে, প্রেম ও সৌন্দর্য-বোধে এবং ঈশ্বর-চিন্তায়  অবিরত আনন্দবাদের বিপরীত অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। তখনকার পাঠককুল কবিতার এই নতুন ধারা দেখে বিস্মিত বোধ করেছে।  নীচের পৃথিবী থেকে ওপরে স্বর্গলোক পর্যন্ত কাল্পনিক মোহাবৃত যে কাব্য-জগৎ সমকালের বাঙ্গালি পাঠককে নিরবধি আচ্ছন্ন রেখেছিল, কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আঘাতের পর আঘাত হেনে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। দুঃখের আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। দুঃখের আঘাতে সত্যের কঠিনকে চিনতে হয়েছে। সে অর্থে যতীন্দ্রনাথ দুঃখবাদী কবি নন। শুধু প্রতিবাদী কবির তকমাও তাঁকে দেওয়া যায় না। মূলত তিনি কাব্যদর্শনে সত্যদর্শী, বাস্তববাদী। 

এই বাস্তবিকতা এবং সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় তখনকার মহানগরীর পথে পথে। নাগরিক জীবন ক্রমশঃ জটিল ও কঠিন এবং দিবারাত্র সমস্যাসঙ্কুল হয়ে উঠছে। সেখানে অকারণ ভাবালুতার প্রশ্রয় নেই, সূক্ষ্ণ মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির নিত্য সংগ্রাম চলছে। অর্থনৈতিক পীড়নে দরিদ্র আরো দরিদ্র হয়ে পড়ছে। চারধারের এই রোজকার দৃশ্য দেখে কল্পভাবনার স্বপ্নদর্শন যতীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেননি। বিপরীত গতিতে এগিয়ে এই ভ্রান্তির স্বপ্ন তিনি ভেঙেছেন। তাঁর কবিতার  “কেতকী”- কে তিনি গ্রামবাংলার বন থেকে কুড়িয়ে পাননি। বৌবাজারের মোড়ে মাংসের দোকানের পাশের ফুলের দোকানটি থেকে কিনে এনেছিলেন। সেই “কেয়াফুল” শহরের কঠিন আবর্তে মনে প্রাণে যেমন ক্ষত-বিক্ষত দিশেহারা, যতীন্দ্রনাথের কবিমন তেমনই জীবন যাপনের দুর্বহ তাড়নায় ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু এখানেই কবি থেমে থাকেননি। কেতকীর মৃত্যুর যন্ত্রণার কারণ খুঁজেছেন। শুধু দুঃখবাদে বিশ্বাস করেননি। সরল আত্মতৃপ্তিতে তাঁর আস্থা নেই। প্রকারান্তরে নিজেকে দুঃখবাদী বললেও হতাশা বা পরাজয় তাঁর অভিষ্ট নয়। শোপেনহাওয়ারের দুঃখবোধের শূন্যতায় যতীন্দ্রনাথ দীক্ষিত নন। কবির তীর্যক বক্তব্য ও প্রবচনের কশাঘাত শোষকশ্রেণীর প্রতি তর্জনী উঠিয়েছে কঠিন শাসনে। নিজেকে সরাসরি দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে তাঁর প্রবল ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র। অনন্য অভিনব ভঙ্গীতে কাব্যজগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাস্তববাদী কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।

জন্মঃ ২৬শে জুন ১৮৮৭

মৃত্যুঃ ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৪

কাব্যগ্রন্থঃ মরীচিকা, মরুশিখা, মরুমায়া, সায়ম, ত্রিযামা, নিশান্তিকা এছাড়া যতীন্দ্রনাথের শেক্সপীয়রের রচনার কিছু অনুবাদ-কর্মও আছে।  

(সূত্র সাহায্য- যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত – কবিমন ও কাব্য (ডঃ জ্যোৎস্না গুপ্ত))




 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours