সজল বোস, ফিচার রাইটার ও সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

আচ্ছা আপনার ছোট বেলার স্মৃতির কথা কিছু মনে আছে?  বললে নিজেই হাসবেন মনে মনে। আচ্ছা ছোট বেলায় খেলার ছলে পাড়ার প্রায় সমবয়সী বন্ধুদের সাথে কখনও রাম-লক্ষণ, কখনও অর্জুন, কর্ণ, মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ হয়ে রামায়ণ, মহাভারতের চরিত্র হয়ে বাঁশের কঞ্চি আর সুতলি দিয়ে ধনুক আর সজনে কাঠি দিয়ে তীর আর সামনে বাবুল বা বেল কাঁটা দিয়ে লক্ষ্য ভেদ করার অভ্যাস করতাম। কি তাইতো? করেছেন না এমন, আবার গাছের ডালে বসে থাকা পাখীর বা পায়রার দিকে ছুঁড়েছি তীর। ফড়িং ধরা, গুলতি বানানো, ব্যাঙের বিয়ে কত কত কি করেছি। কিন্তু তীর ধনুকের মধ্যেই ছিলো একটা বীরত্বের ছোঁয়া। মজা হতো বেশী আর টিভির সেই রামায়ণ মহাভারত যেন প্রতিটি পারায় পারায় মহল্লাতে কত বীরত্বের কাহিনী লেখা আছে। হাসছেন আর সেই সময়ের ফিরে যাবার চেষ্টা করছেন। এটাই স্বভাবিক। আসুন আজ সেই তীর ধনুকের বংশের খবর জানার চেষ্টা করি। 

তীর ধনুকের হান্টিংয়ের ইতিহাস প্রায় ৬৫ হাজার  বছরের পুরনো। ধনুক এবং তীর শিকারের একটি প্রযুক্তি বা পদ্ধতি যা প্রথম আফ্রিকার প্রথম মানুষের দ্বারা তৈরি।  প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ দেখায় যে হিউইসন পোয়ারেজ পর্বের মাঝামাঝি সময় মধ্যপ্রাচ্য যুগের আফ্রিকাতে পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে মানুষের দ্বারা প্রযুক্তিটি ব্যবহৃত হয়েছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এর Pinnacle পয়েন্ট গুহায় কিছু নিদর্শন ও গুহা চিত্র সাম্প্রতিক প্রমাণে ধাক্কা।

যাইহোক, কোনও প্রমাণ নেই যে, ধনুক ও তীর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় যারা প্রায় পনেরো হাজার থেকে পরবর্তী দু হাজার বৎসর আগে লাতিন উচ্চ প্যালিওলিথিক বা টার্মিনাল প্লাইস্টোসিন পর্যন্ত আফ্রিকার বাইরে চলে যান। সেখানে প্রারম্ভিক হোলসিনের ধনুক এবং তীরের প্রাচীনতম জীবন্ত জৈব উপাদান। প্রচীন থেকে আধুনিক সভ্যতায় আর্চারি পৃথিবীর প্রাচীনতম খেলা যা আজকের দিনের মানুষের কাছে এখনো জনপ্রিয় খেলার তালিকায় রয়েছে। 

প্রাচীনকালে তীর বা ধনুক ব্যবহার করে পশু শিকার করা হতো। পরবর্তীকালে হস্তনির্মিত অস্ত্র হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে এর বহুল প্রচলন ঘটে। জানাযায় এটি গোলন্দাজ সৈন্যবিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। নিখুঁত লক্ষ্যভেদে এর জুড়ি ছিল না এবং দক্ষ তীরন্দাজগণ যুদ্ধ জয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতেন। আদি ইতিহাস থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তীর ধনুক একটি অত্যাবশ্যক অস্ত্র ছাড়াও একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলা আর্চারি হিসেবে দেশ ও জাতীয় সীমা পেরিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে সারা বিশ্বে। 

ইতিহাসের বিভিন্ন গল্পে কাব্যে মহাকাব্যে বর্ণিত ব্যক্তি হিসেবে যিনি তীর-ধনুক ব্যবহার করেন বড় যোদ্ধা, সুরবীর বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তিনি তীরন্দাজ বা আর্চার বা বোম্যান নামে পরিচিত ও বিখ্যাত হয়ে আছেন। বহু যুদ্ধের কীর্তির জন্য রাম লক্ষণ, মেঘনাদ, অর্জুন, কর্ণ, দ্রোণাচার্য, ভীষ্ম ও একলব্য ধনুর্বিদ্যা তে পারদর্শী ছিলেন বলেই উল্লেখিত। বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে আজও এই তীর ধনুকের প্রচলন আছে। ভারতের সাঁওতাল বিদ্রোহে এটাই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত একটি অস্ত্র ছিলো। 

আজ সারা বিশ্বে অলিম্পিক বা নানা খেলায় আর্চারি ইনডোর এবং আউটডোর উভয় ক্ষেত্রে খেলা হয়ে থাকে। ইনডোরের ক্ষেত্রে শুটিং লাইন থেকে টার্গেটের দূরত্ব হয় ১৮ থেকে ২৫ মিটারের মধ্যে যা আউটডোরের ক্ষেত্রে হয় ৩০ থেকে ৯০ মিটার। অলিম্পিকে স্ট্যান্ডার্ড দূরত্ব হল ৭০মিটার। আর্চারি প্রতিযোগীতা কয়েকটি ভাগে বা প্রান্তে ভাগ করা হয়। প্রতি ভাগে বা প্রান্তে একজন প্রতিযোগী ৩ থেকে ৬টা তীর ছুড়তে পারে। ইনডোরের ক্ষেত্রে ২০টা প্রান্ত থাকে এবং প্রতি প্রান্তে ৩ টি তীর ছোড়া যায়। আর এ জন্য সময় দেওয়া হয় ২ মিনিট। কেবল সিগ্যনাল দেওয়ার পরেই আর্চাররা তীর নিক্ষেপ করতে পারে। সিগন্যাল দেওয়া হয় লাইট কিংবা পতাকার মাধ্যমে, এক্ষেত্রে কোন শব্দ সংকেত ব্যবহার করা হয় না। তীর টার্গেটের কোথায় আঘাত করেছে তার উপর ভিত্তি করে পয়েন্ট দেওয়া হয়। বাইরের সাদা বৃত্ত থেকে ভিতরের কেন্দ্র পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ১ থেকে ১০ পয়েন্ট দেওয়া হয়। যদি তীর টার্গেট আঘাত না করে তবে সেটাও গণনা করা হয়। যদি কেউ নির্দিষ্ট সময়ের পরে তীর নিক্ষেপ করে তবে শাস্তি হিসেবে সেই প্রান্তের সর্বোচ্চ পয়েন্টটি বাতিল হিসেবে গণ্য করা হয়।  

আমাদের চিন্তায় আসতে পারে তীর হাত দিয়ে নিক্ষেপ করলেই তো হয়, ধনুকের প্রয়োজনীয়তা কি? 

যখন ধনুক ব্যবহার করা হয়, আমাদের হাতের পেশী ধীরে কাজ করেও অনেক বেশি শক্তি অর্জন করে থাকে ও এর পিছনে মূল কারণ হলো ধনুকের স্থিতিস্থাপকতা বা নমনীয়তা। যখন তীর নিক্ষেপ করা হয়, ধনুকের স্থিতিস্থাপকতার কারনে সঞ্চিত শক্তি গতি শক্তিতে রুপান্তরিত করে এবং দ্রুত গতিতে অনেক বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে। যদিও আর্চারি একসময় অবসর যাপনের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হতো, বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে প্রতিযোগিতামূলক খেলা হিসেবে এর কদর রয়েছে। অলিম্পিক গেমস থেকে শুরু করে কমনওয়েলথ গেমসে আর্চারি একটি নিয়মিত ক্রীড়া হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

আধুনিক সভ্যতা হিসেবে পারস্য, মেসিডোনিয়া, নুবিয়া, গ্রীক, পার্থিয়া, ভারতীয়, জাপান, চীন এবং কোরিয়ার সরকার ব্যবস্থায় তাদের সেনাবাহিনীতে ব্যাপক সংখ্যায় ধনুক সংরক্ষণ করা হতো। নিখুঁত লক্ষ্যভেদে এর জুড়ি ছিল না এবং দক্ষ তীরন্দাজগণ যুদ্ধ জয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতেন।

সংস্কৃত শব্দ ধনুর্বিদ্যাকে সাধারণ অর্থে মার্শাল আর্টকে নির্দেশ করা হয়ে থাকে। ধনুর্বিদ্যার উত্থান ঘটে এশিয়ায়। পূর্ব এশিয়ায় কোরিয়ার তিনটি রাজ্যের একটি গোগুরিও রাজ্যে একদল দক্ষ তীরন্দাজের রেজিমেন্ট ছিল।

তবে যাই হোক আজও তীর ধনুক হাতে নিয়ে কেমন একটা যেন ঐতিহাসিক বীর হতে ইচ্ছা করেই তা হয়তো মনের গভীরে স্পর্শ করে। নস্টালজিয়া বা রোমাঞ্চকর নাটক হলেও বেশ আনন্দ উপভোগ করা যায় যদি সেখানে মশলার রঙ থাকে তীর ধনুক। 



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours