রিঙ্কি সামন্ত, লেখিকা, কলকাতা:

'কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝালঝোল রসা

কালিয়া দোলমা বাগা সেকচী সামসা'

(ভারতচন্দ্র)

নদীমাতৃক দেশে বাঙালি যতটা মৎস্যপ্রেমী, ঠিক তেমনি আসক্ত মাংসে। ছুটির দিনে দুপুরবেলার পাতে ধূম্রায়িত ভাত আর কচি পাঁঠার ঝোল না থাকলে আমেজটাই যেন ফিকে হয়ে যায়।

প্রেসার, সুগার, কোলেস্টেরলের চোখ রাঙানি বা করোনার তীব্র আস্ফালনেও এই চারপেয়ের মহিমা অক্ষুন্ন।

পাঁঠার মাংসের কৌলিন্য এসেছে আর্য্যদের কাছ থেকে। মাংস খাওয়াকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আনা হয় 'বলির অনুশাসন'। আরাধ্য দেবতাকে নিবেদনের মাধ্যমে সেই পবিত্র মাংস বা ‘বৃথা মাংস’ ভক্ষণের রয়েছে নানা রীতিনীতি। যেমনটি কোরবানির ঈদে পশু কোরবানির পর সবাইকে মাংস বিতরণ করা হয়।

মাংসে মশলা ব্যবহারের কথা কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্রে আছে। রান্নার বহু কথা জানা যায় পর্তুগিজ ফরাসি, ডাচ আর ইংরেজদের কাছ থেকে। শ্রীহর্ষ রচিত 'নিষাদ চরিত' মহাকাব্যতে নল-দময়ন্তীর বিয়ের অনুষ্ঠানে পাঁঠার সুস্বাদু ঝোলের স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী রচিত 'চন্ডীমঙ্গল' এ ফুল্লরার মাংস বিক্রি ও নানা পদ রান্নার কথা জানা যায়।

ভোজনরসিক ছিলেন আমাদের কবিগুরু। দেশ বিদেশের রান্নার খোঁজ নিয়ে এসে সেগুলিকে ঠাকুরবাড়িতে চালু করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীও ছিলেন রান্নায় দক্ষ। তাই রসনা তৃপ্তিতে কখনও ঘাটতি হয়নি কবিগুরুর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইজি প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী খুব ভালো রান্না করতেন। এঁচোড় দিয়ে খাসির যে মাংস প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী গুরুদেবকে রান্না করে খাইয়েছিলেন। তার রান্না খেয়ে গুরুদেব  ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।

শোনা যায় রাজা রামমোহন রায় নাকি আস্ত একটা পাঁঠা খেতে পারতেন। স্বামী বিবেকানন্দ যখন নরেন নামে নেহাতই স্কুল বালক, তখন নাকি নিত্য স্কুল থেকে ফিরে পাঁঠার মাথার ঘুগনি দিয়ে বেশি না, মাত্র গণ্ডা চারেক রুটি সাবাড় করতেন অক্লেশে। শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মাংস খাওয়া উচিত কি না? স্বামীজী বললেন, ‘খুব খাবি বাবা! তাতে যা পাপ হবে তা আমার।’

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে বাংলার মনিষী আর মাংসের যোগাযোগ অতি ঘনিষ্ঠ।

'মাংসের ঝোল অবশ্য যত বাসি আর যতবার ফোটানো ততই মজে অপূর্ব স্বাদ, ওটা রান্নাঘরের বেদ বাইবেলেই লেখা।' (অন্নপূর্ণা ভাণ্ডার/যশোধরা রায়চৌধুরী)

'হাজারি ঠাকুর মাংস রাঁধিবার একটি বিশেষ প্রণালী জানে, মাংসে একটুকু জল না দিয়া নেপালী ধরনের মাংস রান্নার কায়দা সে তাহাদের গ্রামের নেপাল-ফেরত ডাক্তার শিবচরণ গাঙ্গুলীর স্ত্রীর নিকট অনেকদিন আগে শিখিয়াছিল' (আদর্শ হিন্দু হোটেল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

প্রেসার কুকার যখন আসেনি, তখন হাঁড়ি বা কড়াতেই মাংস রাঁধা হত, আর অনেক সময় সুসিদ্ধ হবার জন্যে তাতে ফেলে দেওয়া হত পেঁপে।

মাংস খাওয়ার প্রসঙ্গে শিবরাম চক্রবর্তীর একটি হাসির ঘটনা বলি।

নেমন্তন্ন বাড়িতে খাসির মাংস খেতে খেতে শিবরাম চক্রবর্তী থেমে গিয়ে বললেন‚ "অনেক বেশি মাংস খেয়ে ফেলেছি তাই ব্লাডপ্রেসারটা এখন হাই হয়ে গেছে"। এই বলে পকেট থেকে কয়েকটা ওষুধ বার করে টপাটপ খেয়ে নিয়ে বললেন‚ "এতে প্রেসার কমল বটে কিন্তু অনেকটাই কমে গেলো‚ মানে লো প্রেসার হয়ে গেলো। এখন আরও মাংস না খেলে প্রেসার নর্মাল হবে না"।

আবার শিবরাম চক্রবর্তী মাংস খাওয়া শুরু করলেন।

খেতে আমরা সকলেই কম-বেশী ভালোবাসি। বাজারদর কেজি প্রতি 700 টাকা হলেও ছুটির দিনে এর চাহিদা তুঙ্গে। তবে অতিরিক্ত নয়, পরিমিত খাবারেই খাওয়ার আসল তৃপ্তি মেটে।পাঁঠার মাংসের স্বাদ বা গ্ল্যামার অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করাই অন্যায়। এ যেন ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনের সঙ্গে পাড়ার জলসার তুলনা। পাঁঠার মাংসের সার্বজনীননতা শৈশব থেকে সামিল হয়েছে আমার আপনার মতো অনেকের জীবনেই। স্বাদের তৃপ্তি ঘটুক সকলের পরিমিত ব্যবহারে।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours