সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

মমি শব্দটি মধ্য যুগের ল্যাটিন ও আরবী শব্দ মুমিয়া এবং ফার্সি ভাষা মোম থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো বিটুমিন। তবে অধিকাংশ গবেষকদের মতে মমির উৎপত্তিস্থল হলো প্রাচীন মিশর। তা ছাড়া এও মনে করা হয় যে, এই মিশরীয় সভ্যতারও এক হাজার বছর পূর্বে উত্তর চিলি ও দক্ষিণ পেরুর চিনচেরাতে মমির সংস্কৃতি প্রথম চালু হয়। 

আমরা প্রত্যেকেই জানি মৃত্যুর পর মমিতে পরিণত হওয়াটা ছিল প্রাচীন মিশরের একটা ধর্মীয় বিশ্বাস ও আভিজাত্যের প্রতীক। এই সময় কোন মৃতদেহকে মমিতে পরিণত করাটা ছিল ভীষণ ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে দেশের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরাই কেবল এই মমিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ পেতেন। মৃত দেহের শরীর থেকে সমস্ত পচনশীল অঙ্গগুলো বের করে শরীরটাকে সেলাই করে দেয়া হতো। তারপর ওই মৃত শরীরটাকে রাসায়নিক পদার্থ মেশানো কাপড়ে জড়িয়ে দীর্ঘদিন ধরে মমি তৈরি করে রেখে দেওয়া হতো। এই মমি বানানোর কাজ করত তখনকার মানুষেরাই।

আপনারা কি জানেন, পৃথিবীতে এমন একটি জায়গা রয়েছে যেখানে প্রকৃতি নিজেই মমিতে পরিনত করে বিভিন্ন প্রাণীর দেহকে। এখানে যদি কোন প্রাণী কিছুক্ষণ অবস্থান করে তা হলে সেই প্রাণীটি মমিতে পরিণত হয়ে যায়। হ্যাঁ  পৃথিবীতে এমনই একটি হ্রদ আছে যার নাম 'লেক ন্যাট্রন' বা 'ন্যাট্রন হ্রদ'। এই লেকটির দৈর্ঘ্য ৫৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২২ কিলোমিটার। এওয়াসো নায়গ্রো নদী ও  আশপাশের বেশ কয়েকটি উষ্ণ প্রস্রবণের জল এই হ্রদে এসে পড়ে। ফলে বিভিন্ন খনিজে সমৃদ্ধ এই হ্রদের জল। এই হ্রদটি আফ্রিকার তানজানিয়ার আরুশা অঞ্চলে অবস্থিত।পৃথিবীর বহু বিখ্যাত বিখ্যাত ছবি এখানেই তোলা হয়েছিল।  

অতীতে এই হ্রদ নিয়ে অনেক কথা শোনা গেলেও তার কোন প্রমাণ মেলেনি। তবে ২০১১ সালে নিক ব্রান্ডট নামে এক ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার যখন এই ন্যাট্রন হ্রদের সামনে জান তখন তিনি সেখানে গিয়ে কিছুটা হলেও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি হ্রদের পাড়জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন অসংখ্য পশুপাখির দেহ। ব্রান্ডট এর কথা অনুযায়ী, সেই প্রাণীগুলোকে দেখে তার মনে হয়েছিল, কেউ যেন সেখানে কোনও পাথরের মূর্তিকে সাজিয়ে রেখেছে।

এবার স্বাভাবিক ভাবেই আপনার মনে প্রশ্ন জাগবে, প্রাণীদের এভাবে মমিতে পরিণত হয়ে যাওয়ার কারণ কি? অথবা, অনন্য সুন্দর এই হ্রদটির ভয়াবহতার রহস্যটা আসলে কি?

রহস্যটা আসলে এই লেকের পাশে থাকা একটা সক্রিয় আগ্নেয়গিরিকে ঘিরে। যে আগ্নেয়গিরিটির নাম "ওল দইন্নো লেঙ্গাই"। এই আগ্নেয়গিরিটি খুবই বিরল প্রকৃতির। তার কারণ এটি থেকে সোডিয়াম কার্বনেট ও পটাশিয়াম কার্বনেট মিশ্রিত লাভা নিঃসরণ হয়। যা ন্যাট্রকার্বনাটাইট বা সংক্ষেপে ন্যাট্রন নামে পরিচিত। এটি এতটাই ক্ষারীয় যে এই লেকের pH এর মাত্রা ১০.৫ এর উপরে। মনে করা হয় প্রায় ২৬ লক্ষ বছর আগে প্লিসটোসিন যুগে প্রচুর সোডিয়াম ও কার্বোনেট যুক্ত ট্র্যাকাইট লাভা দিয়ে তৈরি হয়েছে এই ন্যাট্রন  হ্রদের তলদেশ।বছরের বেশির ভাগ সময়ই এই লেকের তাপমাত্রা থাকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।যে কারনে জল বাষ্পীভূত হয়ে যায় দ্রুত। আর জলের মতো তরল লাভা পড়ে থাকে এই হ্রদের  তলদেশে।

সোডিয়াম ও কার্বনেটের কারনে এই লেকে জন্মায় সায়োনোব্যাকটিরিয়া। এই ব্যাকটিরিয়ার শরীরে এক প্রকার লাল রঞ্জক পদার্থ থাকে। যার কারনে লেকের জল লাল রঙের দেখায় । বিজ্ঞানীদের মতে,পশুপাখিরা সেই লাল রঙে আকৃষ্ট হয়েই লেকে নামে। কিন্তু এই হ্রদে অতিরিক্ত ক্ষারধর্মীর জলের কারনে তাদের মৃত্যু হয়। 

ন্যাট্রন উপাদানটিকেই প্রাচীন মিশরে মমি বানানোর মূল কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এই ন্যাট্রন উপাদানটি উত্তম সংরক্ষণ হিসেবে কাজ করে, তাই এই হ্রদে যে সব প্রাণী বেশিক্ষণ ধরে থাকে তাদেরই মৃতদেহ গুলি মমির আকার ধারণ করে বছরের পর বছর সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু ফ্লেমিঙ্গো নামে এক শ্রেণীর পাখি এখানে অবাধে ঘুরে বেড়ায়। শুধু তাই নয় তারা এই হ্রদের জলও পান করে থাকে। এরা নাকের একটি বিশেষ গ্রন্থির সাহায্যে জল আর ন্যাট্রনকে আলাদা করতে সক্ষম। তাছাড়া এদের শক্তিশালী পাকস্থলী থাকায় এই হ্রদের দূষণকে তারা হজম করে ফেলতে পারে।

শুধু তাই নয় এদের পায়ের চামড়া আঁশযুক্ত ও জল প্রতিরোধক। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে এরা এই হ্রদের জলে অবাধে বিচরণ করতে পারে। এই হ্রদের ভয়াবহতার দরুন এখানে শিকারী প্রাণীদের আনাগোনা নেই বললেই চলে। ফলে এই ন্যাট্রন হ্রদটি হয়ে উঠেছে তাদের বংশ বিস্তারের জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা।

একমাত্র ফ্লেমিঙ্গোই এই চরম পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সামর্থ্য হয়েছে। তাই, যেখানে অন্যান্য প্রাণীদের জীবন সংশয় হয় এই হ্রদে। সেখানে এদের জন্য এই জায়গাটি হয়ে উঠেছে স্বর্গ।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours