আজ বড্ড মনে পড়ছে স্বর্গীয়া মায়ের একটা কথা। কি পরম সাত্ত্বিক না ছিলেন আমার জন্মদাত্রী।
মহালয়ার দিন মানেই সেই নিয়ম করে কাক ভোরে রেডিও চালানো। প্রতি বছর। তারপর পুজোপাঠ। ব্যতিক্রম ছিল না শত শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও।
এদিন আরও একজনের কথা 'স্মরণে আসে মোরে।' খুব মনে আসছে সেই মানুষটার কথা। মারা গেছেন অনেক আগেই। কল্যাণ ভদ্র। বন্ধ হয়ে যাওয়া যুগান্তকারী পেপার 'যুগান্তর'। মনে পরে কি? এক সময় ওই সংবাদপত্রে নিয়মিত রম্য রচনা লিখতেন তিনি। তদানীন্তন সময়ে তিনি বেশ জনপ্রিয় রম্যরচনা লিখিয়ে। বলতে দ্বিধা নেই সেই সময় থেকেই আমি তার লেখা পেলেই পড়তাম। পড়ার শেষে এক তৃপ্তির হাসিতে তখন আমার এক অদ্ভুত অনুভূতি হতো। যা আজও আমাকে নাড়া দেয়।
এসবের বছর খানেক বাদের কথা। বিগত বছর তেত্রিশ তো হবেই কমবেশি। কলকাতা থেকে রমরমিয়ে তখন প্রকাশিত হচ্ছে সাপ্তাহিক 'জনমন জনমত'। আমি সেই পত্রিকার দুর্গাপুর করেসপন্ডেন্ট ছিলাম। প্রধান সম্পাদক বেনুগোপাল চক্রবর্তী আমায় খুব ভালোবাসতেন আমার কাজের জন্য। একদিন কলকাতার অফিসে যেতেই বেনুদা তাঁর চেম্বারে ডেকে পাঠালেন। দরজা খুলে ঢুকতেই দেখি প্রধান সম্পাদকের মুখোমুখি বসে আছেন এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক। চোখে কালো ফ্রেমে চশমা। কালো চুল বেশ পরিপাটি করে আঁচরানো। ফর্সা মুখ। সাদা জামা পরিহিত। আমি এক বিস্ময় ঘোর চোখে তাকিয়ে পরখ করছি তাঁকে। বেনুদা সেটা বুঝতে পেরে আমাকে বললেন উনি কে জানো সুবীর? ঘাড় নাড়িয়ে না বলতেই বেনুদা এবার জানালেন, নিশ্চয়ই শুনেছো যুগান্তর বন্ধ হয়ে গেছে। উনি আমাদের পত্রিকাতে যুক্ত হয়েছেন। উনার নাম কল্যাণ ভদ্র। আমি হতবাক তখন। যে মানুষটার লেখা পড়ার জন্য আমি হা পিত্যেস করতাম সেই রম্যরচনাকার আজ আমার সামনে বসে! এই কল্যাণ ভদ্র আজ আমার উর্ধতন সহকর্মী! আমি চমকে গেলাম বেনুদার কথায়। তখনই দুজনকে প্রণাম করি। আমি এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছি দেখে পাক্কা ব্যবসায়ী বেনুদা বললেন আরে বসো বসো। কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবে? আমি বসতেই তিনি আবার শুরু করলেন, যে কল্যাণ ভদ্রকে তুমি রম্যরচনাকার হিসেবে চেন তাঁর আরও একটা পরিচয় আছে। তা কি তুমি জানো? আমি আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এ যেন ক্রিকেট মাঠে চন্দ্রশেখর একের পর একেকটা গুগলি বল পিচে ফেলছেন। বেনুদা হাসতে হাসতে ৫৫৫ (555) সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, মহালয়ার একক সম্রাট বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ইনি যে বড় ছেলে। বিশ্বাস করুন এই কথা শুনে আমি সেদিন কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে যাই। যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ শুনলে আমার গায়ে লোমকূপ বারংবার কেঁপে ওঠে আজ তাঁরই ছেলে কিনা আমার পাশের চেয়ারে বসে। তাও আবার আমার সঙ্গে কি মারকাটারি রসিকতাই না করে চলেছে।
এর মধ্যে কল্যাণদার সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ জমে ওঠে। আমি প্রায়ই কলকাতা গেলে দেখাও হতো উনার সঙ্গে। সেকি প্রাণ খোলা ইয়ার্কি মারতেন মানুষটা। এমন ভাবেই মাস তিনেক কেটে যায়। একদিন পত্রিকার তরফে ঠিক হল দুর্গাপুরে একটা জনসংযোগমূলক অনুষ্ঠান করা হবে। যথারীতি অনুষ্ঠান হল সফল ভাবেই। হাজির ছিলেন কলকাতা থেকে বেনুদা, কল্যাণদা ও কল্যাণদার স্ত্রী।
পরের দিন বিকেলে আমাদের ঘরে আসার জন্য আমার মা তিনজনকেই নিমন্ত্রণ করলেন। এই শুনে মায়ের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে আরও একদিন দুর্গাপুরের একটি গেস্ট হাউসে থেকে গেলেন তাঁরা। আসলে আমার মা ছিলেন অদ্ভুত ব্যক্তিত্বময়ী। তাঁর অনুরোধ সত্যি এড়ানো মুস্কিল ছিল। মায়ের আমন্ত্রণ রক্ষায় আমাদের বাড়িতে একসময় কত গুনীজন আসতেন। রামকৃষ্ণ মিশনের কত সন্ন্যাসীর যে পূন্য পদধুলি পড়তো আমাদের ঘরে। সবাইকে মা পায়েস রান্না করে খাওয়াতেন।
সেদিনও মা পায়েস রান্না করেছিলেন। বাটি ভর্তি লালচে পায়েস তিনজনকে এগিয়ে দিতেই কল্যাণদা বললেন, বৌদি আমি সব খাব কিন্তু পায়েসের বাটিটা সরিয়ে নিন। এটা আমি খাব না। সুগারের সমস্যা আছে যে। অমনি মা বললেন, হতেই পারে সুগারের অসুবিধা। খুব জোর করবো না। শুধু এক চামচ খান। এটা আমার অনুরোধ। তাতেও কল্যাণদা পায়েস না খাবার ছুঁতো খুঁজছেন। তখন পাশ থেকে কল্যাণদার স্ত্রীও জানালেন, সত্যি মিষ্টি খেলে ওঁর সমস্যা হতে পারে।
শেষে মা বললেন, আমি ছেলের কাছে শুনেছি কল্যাণবাবু শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পুত্র। আমার সেই সৌভাগ্য নেই যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে আমি কোনও দিন নিজের হাতে রান্না করা পায়েস খাওয়াতে পারবো। তবে ওই মহাপ্রাণের রক্তধারা যে বইছে কল্যাণবাবুর শরীরে। নাইবা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে আমি সামনে পেলাম কিন্তু তাঁর পুত্র যে আজ আমার ঘরে উপস্থিত। আমি তাই এই পবিত্র রক্তধারাকে প্রণাম জানিয়ে শেষবার অনুরোধ করবো, এক চামচ নাই বা খেলেন অন্তত একটিবার জিবে লাগিয়ে স্বাদ অনুভব করুন। তাতেই মনে করবো আমার তৈরি করা পায়েস খেলেন স্বয়ং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
মায়ের এই কথা শুনে কয়েক সেকেন্ড ঘরের সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কল্যাণদা শুধু একটাই কথা বললেন, বৌদি আমি আমার বাবার যোগ্য সন্তান হতে পারিনি। আপনার এই কথা বাবাকে বলতেও পারবো না যে। কারণ তিনি সেই সুস্থ মানসিক অবস্থা নেই। তবে আপনি আজ আমার প্রাপ্য না হলেও যে শ্রদ্ধা আমাকে দিলেন তা নিজস্ব জীবনে পাওয়া সেরা সম্মান। এই বলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি পুরো বাটি ভর্তি পায়েসটাই খেয়ে নিলেন। কল্যাণদা আবার বলে উঠলেন, আমার বাবার উদ্দেশ্যে আপনার পুজোর অর্ঘ স্বরূপ এই পায়েস আমি অমৃত প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করলাম। আমি এই শ্রদ্ধার যোগ্য নই বৌদি। মা তখন একটা কথাই বললেন, মহালয়া যতদিন পূজিত হবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রও যে ততদিন বাঙালির হৃদয়ে নমস্যঃ হয়েই থাকবেন। তাই আপনার পরমার্থ শোণিতধারাকে আজ সামনে পেয়ে যেন অনুভব করছি মহালয়ার স্বর্গময় কন্ঠ বিশ্বকর্মা আমার ঘরেই হাজির দৈববশে।
আজ আবার ক্যালেন্ডারে তিথি মতে উপস্থিত মহালয়া। পাড়ায় পাড়ায় মাইকে বাজছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই চির পরিচিত অথচ কি নতুন ভাবে বারবার শোনা চন্ডীপাঠ। মনে পড়ছে মায়ের সেদিনের কথাগুলো। স্মৃতিতে ভেসে আসছে কল্যাণদার সেই পায়েস খাওয়া। আর দূর থেকে কানে শুনতে পাচ্ছি, যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা...
Post A Comment:
0 comments so far,add yours