সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

নানা সাহারা মানে একটি বাণিজ্য সংস্থা নয়, সাহারা মানে বালির সমুদ্র, আর আজকের ডেস্টিনেশন সেই  পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমি সাহারা। সেই ছোট্টো বেলায় ভূগোল পাঠ্যসূচীতে জেনেছিলাম বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান। তবে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি যে, কয়েক কোটি বছর আগে এই মরুভূমির জায়গায় ছিল টেথিস সাগর। 

আরবীতে 'সাহার' শব্দের অর্থ হলো-মরুভূমি। ভূ-বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে প্রায় ১০,৫০০ খ্রিষ্টান পূর্বাব্দের দিকে এই অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো। এই সময়ের বেশ কিছু হ্রদ ও ছোট নদীর অবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সময় এই অঞ্চলে গভীর অরণ্য ছিল। এই অঞ্চলে তখন আদিম মানুষের একটি অংশ বসবাস করতো। প্রায় ৭,৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে শুরু করে। এই সময় এর অরণ্য বিলুপ্ত হতে থাকে। ৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে সাহারার মরুভূমিতে পরিণত হয়। আর চিরতরে সবুজ রঙ মুছে গিয়ে ধূসর মরুতে রূপান্তর হয়, ফলে ক্রমেই এই অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ে।

ভূবিজ্ঞানীরা সাহারা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার পিছনে দুটি কারণ উল্লেখ করে থাকেন।

১৮ কোটি ৪০ লক্ষ পূর্বাব্দে,  গোণ্ড্‌ওয়ানা মহামহাদেশর মধ্যাঞ্চলে ছিল আফ্রিকা। এই অংশ থেকে এ্যান্টার্ক্টিকা, মাদাগাস্কার, ভারত এবং অষ্ট্রেলিয়া পৃথক হয়ে গিয়েছিল। ৬.৬ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকা উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই সময় আফ্রিকা ও ইউরোপের মাঝে ছিল টেথিস সাগর। পৃথিবীর ভূগর্ভে পাত সঞ্চালনের ফলে আফ্রিকা ও ইউরোপ একীভূত হয়ে যায়। এই সময় আফ্রিকার উত্তরাংশ সঙ্কুচিত হয়ে সাগরপৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠে আসে। এছাড়া আফ্রিকার স্থান পরিবর্তনের ফলে, মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের পরিবর্তন ঘটে। উভয় মিলে সাহারার বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যায়।

বিজ্ঞান গবেষণায় প্রতি কুড়ি হাজার বছর পর পর পৃথিবী তার নিজ কক্ষপথে সামান্য উত্তর দিকে কাত হয়ে যায়। এর ফলে পৃথিবীর মৌসুমী বায়ুর গতিপথ পরিবর্তিত হয়।  এর ফলে সাহারাতে মৌসুমী বায়ু প্রবাহে আমূল পরিবর্তন ঘটে। মৌসুমী বায়ু না থাকার কারণে, সাহারায় বৃষ্টিপাত কমে যায় এবং ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হয়।

আফ্রিকার  উত্তরাংশে বিশাল অংশ জুড়ে এই মরুভূমিটি অবস্থিত। এর পূর্বে লোহিত সাগর, উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পশ্চিমে আট্‌লান্টিক মহাসাগর, দক্ষিণে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রায়-অনুর্বর শুষ্ক অঞ্চল সাহেল, আলজেরিয়া, চাদ, মিশর, লিবিয়া, মালি, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, নাইজার, পশ্চিম সাহারা, সুদান এবং তিউনিসিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল। ভূতাত্ত্বিকদের মতে যেখানে বৃষ্টিপাতের হার বছরে ১০ ইঞ্চির কম হয়ে থাকে, সেই অঞ্চলকে মরুভূমি বলা হয়। এই বিচারে আর্কটিক এবং এন্টার্কটিকা মহাদেশকেও মরুভূমি বলা হয়। এই দুটি মরুভূমিকে বলা হয় শীতল মরুভূমি। আয়তনের দিক থেকে সাহারা তৃতীয় স্থান দখল করে আছে। পরিসংখ্যানের বিচারে সাহারাকে তৃতীয় বৃহত্ত্বম মরুভূমি বলা হয়। উত্তর আফ্রিকার ৩১% অংশ জুড়ে সাহারা মরুভূমি অবস্থিত। এর আয়তন ৯০ লক্ষ ৪০ হাজার  বর্গকিলোমিটার। আর যদি এর সাথে বছরে ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকাগুলোকে যোগ করা যায়, তাহলে সাহারার মোট আয়তন দাঁড়াবে ১১০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার।

সাহারা মরুভূমি মূলত পাথুরে মালভূমি ও বালির সমুদ্র দিয়ে গঠিত। ঢেউ খেলানো মরু বালি দ্বারা আবৃত এই মরুভূমির কোথাও কোথাও সুউচ্চ বালিয়াড়ি দেখা যায়। এদের বেশিরভাগের উচ্চতা ১৮০ মিটারের বেশি হয়। বাতাস এবং হাল্কা বৃষ্টিপাতের কারণে এ সকল বালিয়াড়ি তৈরি হয়ে থাকে। আর রয়েছে প্রায় সমতল দীর্ঘ বালুকাময় ভূমি । এই প্রান্তরকে অনেক সময় বালির সাগর বলা হয়।  মধ্যে এয়ার পর্বতমালা, আহাগার পর্বতমালা, সাহারান অ্যাটলাস, তিবেস্তি পর্বতমালা, আদ্রার দে ইফোরাস এবং রেড সি হিলস উল্লেখযোগ্য।

সাহারা মরু অঞ্চল অনুর্বর। তাই বিশাল অঞ্চল জুড়ে গাছপালা দেখা যায় না। তবে ওয়াদিস এর মত মরুভূমির উত্তর এবং দক্ষিণ অংশসহ উঁচু এলাকাগুলোতে মরুদ্যান, তৃণভূমি, ঝোপঝাড় এবং কিছু গাছপালার দেখা পাওয়া যায়। মধ্য সাহারার এলাকাগুলোর মধ্যে তানেযরফ্ত, তেনেরে, লিবিয়ান মরুভূমি, পূর্বাঞ্চলের মরুভূমি, নুবিয়ান মরুভূমি এবং অন্যান্য এলাকাগুলো সাহারার সবচেয়ে শুষ্ক এলাকা। এসব অঞ্চলের কখনও কখনও স্থানে সারা বছরে কোন সময়েই বৃষ্টি হয় না।

সাহারা মরুভূমির আকাশ সাধারণত মেঘমুক্ত পরিষ্কার থাকে। দিনের স্থায়িত্ব কালও অত্যন্ত দীর্ঘ। এর বেশিরভাগ অংশ বছরে ৩,৬০০ ঘণ্টা বা ৮২% এর বেশি সূর্যরশ্মি পেয়ে থাকে এবং পূর্বাঞ্চলে এর পরিমাণ ৪,০০০ ঘণ্টা বা ৯১% এর বেশি। দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যের আলো ও তাপের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া গাছ-পালা না থাকা, স্বল্প মাত্রার বৃষ্টিপাত এবং কম আর্দ্রতার ফলে সাহারা সবচেয়ে উত্তপ্ত মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোনো অঞ্চলে এই তাপামাত্রা ৪৬-৪৭ সেলসিয়াসে পৌঁছায়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ছিল আলজেরিয়ান মরুভূমির বোউ বারনোস শহরের দখলে, ৪৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এটিই এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গড় তাপমাত্রার স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাতাসের তাপমাত্রার চেয়ে মরুভূমির বালুর তাপমাত্রা আরও বেশি হয়ে থাকে। মধ্য সাহারার গাছপালাহীন মরু সাগরে বালির তাপমাত্রা প্রায় ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। উল্লেখ্য, সুদানে মরুবালুর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮৩.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। লিবিয়ার আল‍-আজিজিয়াকে পৃথিবীর উষ্ণতম স্থান।

বাতাসে কম আর্দ্রতা এবং আকাশে মেঘ স্বল্পতার কারণে মরুভূমিতে সাধারণত প্রতিদিন দিন ও রাতের তাপমাত্রার বিশাল পার্থক্য ঘটে। দিনে প্রচণ্ড গরম আর রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। রাতের বেলা সাহারার দৈনিক গড় তাপমাত্রা সাধারণত ১৩ থেকে ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। কখনও কখনও তাপমাত্রা উপকূলীয় এলাকায় ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে নামে। 

সাহারার জীব-বৈচিত্র্য

মরুভূমি হলেও সাহারার আছে মরু অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ভিত্তিক বিচিত্র জীবজগৎ। সাহারা মরুভূমিতে প্রায় ২৮০০ প্রজাতির বৃক্ষ দেখা যায়। এর প্রায় এক-চতুর্থাংশ সাহারার স্থানীয় উদ্ভিদ। এর ভিতরে মধ্য সাহারায় ৫০০ প্রজাতির গাছ। এর ভিতরে খেজুর, সাকুলেন্ট, মরুকাঁটা গাছই বেশি। এছাড়া রয়েছে মরুঘাস। মরুভূমির শুষ্ক পরিবেশ এবং মরু ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার উপযোগী দৈহিক গঠন বিশেষভাবে এখানকার প্রায় সকল বৃক্ষের ভিতরে দেখা যায়। এদের কাণ্ডগুলো বেশ স্থূলকায় হয়ে থেকে। এদের শিকড়গুলো মাটির বেশ গভীরে প্রবেশ করে। গাছগুলোর পাতাগুলো হয় ছোট এবং মোটা। কাঁটাগাছগুলো পাতা অথবা কাঁটা যা আর্দ্রতা ধরে রাখতে সহায়তা করে।

সাহারা মরুভূমির প্রাণীকুলও বেশ সমৃদ্ধ। এখানে সাপ, গিরগিটি ও খেঁকশিয়ালের মত প্রাণী বাস করে।  সাহারায় বেশ কয়েক প্রজাতির শিয়ালের বাস। তাদের মধ্যে ফেনেক ফক্স, পেল ফক্স এবং রুপেলস ফক্স অন্যতম। এডেক্স নামক বিশাল এন্টিলোপরা সাহারা মরুভূমিতে বাস করে। এরা জল ছাড়া প্রায় এক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এছাড়া রয়েছে উট। আলজেরিয়া, তোগো, নাইজার, মালি, বেনিন এবং বুরকিনা ফাসো অঞ্চলে সাহারান চিতার দেখতে পাওয়া যায়। এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এরা সূর্যকিরণে বের হয় না। এই চিতাবাঘগুলো সাধারণত ফ্যাকাসে বর্ণের হয়। সাহারান চিতা ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির চিতাগুলো চাদ, সুদান এবং নাইজারের পূর্বাঞ্চলে বাস করে। এছাড়া সাহারা মরুভূমিতে মনিটর লিজার্ড, হাইরেক্স, স্যান্ড ভাইপার, রেড-নেক অস্ট্রিচ, আফ্রিকান সিলভার বিল, ব্ল্যাক ফেইসড ফায়ারফিঞ্চ এবং কিছু সংখ্যক আফ্রিকান বুনো কুকুর বাস করে। মৌরিতানিয়া এবং এনেদি মালভূমিতে কিছু ছোট প্রজাতির কুমির বাস করে।

এই মরুভূমিতে প্রাণঘাতী ডেথ স্টকার বিছা রয়েছে, এরা প্রায় ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এই বিছার বিষে অনেক বেশি পরিমাণে এজিটক্সিন এবং সাইলাটক্সিন থাকে। এই বিষ সাপের বিষের মতই ভয়ঙ্কর। সাহারান সিলভার অ্যান্ট বা রূপোলী পিঁপড়ে সাহারা মরুভূমির উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে এবং শিকারির কবল থেকে বাঁচার জন্য দিনে কেবল ১০ মিনিটের জন্য এরা আস্তানা থেকে বের হয়। সাধারণত পালিত পশু হিসেবে বিবেচ্য ড্রমেডেরি উট এবং ছাগলের দেখা মেলে সাহারা মরুভূমিতে।

রয়েছে বহু আধুনিক শহর এবং জনঅধ্যুষিত অঞ্চল। দিনের উত্তাপ এবং রাতের শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আধুনিক ব্যবস্থায় বসবাস করে। এর বাইরে রয়েছে বেশ কিছু যাযাবর গোষ্ঠী। প্রায় ১০ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে মানুষের বসতি ছিল। এই সভ্যতা গড়ে তুলেছিল কিফিয়ান সংস্কৃতি জনগোষ্ঠী।

সাহারার লিবিয়া ও আলজেরিয়া অংশে প্রচুর তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া গেছে। তা ছাড়া এই মরুভূমিতে তামা, লোহা, ফসফেট ইত্যাদি অনেক খনিজ দ্রব্যও আছে।  

সর্বশেষ বিজ্ঞানীদের ধারণা করা হয় ১৫ হাজার বছর পর সাহারা মরুভূমি আবারো সবুজ হয়ে উঠবে।

তাই আশা হোক পৃথিবীর আবহাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন হবে নিজের মতো করেই। হয়তো সার্থক হবে চেরাপুঞ্জির মেঘগুলো হয়তো ঠিকনা বদল করবে, অঝোরে ঝরে পড়বে সাহারার বুকে।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours