অমৃত রঞ্জন গোস্বামী, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

".... নিউইয়র্কে দেখিতাম, আইরিশ ঔপনিবেশিকগণ আসিতেছে --- ইংরেজ-পদ-নিপীড়িত, বিগতশ্রী, হৃতসর্বস্ব, মহাদরিদ্র, মহামূর্খ -- সম্বল একটি লাঠি ও তার অগ্রবিলম্বিত একটা ছেঁড়া কাপড়ের পুটলি। তার চলন সভয়, তার চাউনি সভয়। ছ-মাস পরে আর এক দৃশ্য -- সে সোজা হয়ে চলেছে, তার বেশ-ভূষা বদলে গেছে; তার চাউনিতে, তার চলনে আর সে "ভয়-ভয়" ভাব নাই। কেন এমন হল? আমার বেদান্ত বলছেন যে, ঐ Irishman - কে তাহার স্বদেশে চারিদিকে ঘৃণার মধ্যে রাখা হয়েছিল -- সমস্ত প্রকৃতি একবাক্যে বলেছিল, 'প্যাট, তোর আর আশা নাই, তুই জন্মেছিস্ গোলাম, থাকবি গোলাম।' আজন্ম শুনতে শুনতে প্যাট-এর তাই বিশ্বাস হল, নিজেকে প্যাট সম্মোহিত করলে যে, সে অতি নীচ; তার ব্রহ্ম সংকুচিত হয়ে গেল। আর আমেরিকায় নামিবামাত্র চারদিক থেকে ধ্বনি উঠল --- 'প্যাট, তুই ও মানুষ, আমরাও মানুষ, মানুষেই তো সব করছে; তোর আমার মত মানুষ সব করতে পারে, বুকে সাহস বাঁধ।' প্যাট ঘার তুললে, দেখলে ঠিক কথাই তো; ভিতরের ব্রহ্ম জেগে উঠলেন, স্বয়ং প্রকৃতি যেন বললেন, 'উত্তিষ্ঠত জাগ্রত'।" অর্থাৎ -- "ওঠো, জাগো"।

এটি স্বামী বিবেকানন্দের মার্কিন দেশে থাকা কালীন একটি টুকরো অভিজ্ঞতা। এই বিবরণেই লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার প্রয়োজন। মানুষের চেতনায় তার প্রভাবের প্রমাণ। একজন স্বতন্ত্র মানুষ কিংবা সামগ্রিক একটি জাতির জন্য স্বাধীনতা হ'ল, মানুষ রূপের সম্পূর্ণ বিকাশের প্রাথমিক শর্ত। পরাধীনতা এক ধরনের বেশ উর্বর জমি, যার মধ্যে উঁচু দরের হীনমন্যতার চাষ হয়। 

আমাদের চায়ের কাপে উত্তেজনা ছড়ায় যে স্বাধীনতার আলাপচারিতা, তা হ'ল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। কাগুজে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথকতা। এই বাহ্যিক পরিবর্তন মানুষের আত্মিক উন্নতি সাধনে অক্ষম। এমন মোটা দাগের পরিবর্তনে কেবল পরিচালকের রূপ বদলায়, পরিচালনার পন্থার নয়। তার গুণগত মানের নয়। এগুলি ব্রাত্যই থেকে যায় সবসময়! কিন্তু প্রকৃত স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের ছবি এমন হওয়া উচিৎ, যেখানে তার নাগরিকদের সম্পূর্ণ আত্মিক বিকাশের পরিকাঠামো থাকবে। আজকের ভাষায় বললে, Full Manifestation of Human Resource. নতুবা সারাটা জীবনই মানব জমিনগুলি পতিতই রয়ে যাবে, আর সোনা ফলানো হবে না সেখানে! নাগরিকদের প্রয়োজন একটি চিন্তার স্বাধীনতা, কল্পনার স্বাধীনতা, আবেগের স্বাধীনতা, বিচারের স্বাধীনতা, বক্তব্য পেশ করার এবং নিরপেক্ষ মতামত পোষণ ও ব্যক্ত করার স্বাধীনতা। এখানে স্বাধীনতা এসে, আতঙ্কহীন একটি অতি কাঙ্খিত  সমাজের সাথে এক হয়ে যায়।

 স্বাধীনতার এই দিকটি ছাড়াও, আরও একটি সূক্ষ দিক আছে। সেই সূক্ষ স্তরে পৌঁছান্ খুব অল্প সংখ্যক মানুষ এবং তাঁরাই একটি জাতিকে আলোর পথ দেখান। তাঁরা শারীরিক চিন্তায় আবদ্ধ নন, তাঁদের স্বাধীনতার বসত চেতনায়। তাঁরা প্রতিকূলে সাঁতার কাটেন। যাঁরা মুক্তির জন্য লড়েন, তাঁরাও কিন্তু সেই পরাধীন দেশের পরিস্থিতি মেনে নেওয়া অন্যান্য মানুষদেরই সহ-নাগরিক। তাহলে ফারাকটা কোথায়? ফারাক থাকে চেতনায়!! তাই এই পোড়া দেশের বিপ্লবীরা বারংবার বলতে পেরেছেন -- ব্রিটিশ শক্তি আমার শরীরকে বন্দি করতে পারবে, আমার চেতনাকে নয়। আমাকে মারতে পারবে, আমার বিচারধারাকে নয়, তা পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে একই পথের পথিক হতে। শরীর কেন্দ্রীক চিন্তায়, শরীর নাশের ভয় সবসময় বর্তমান। এই স্থূল ভয় নিয়ে বড় কোনও কাজ করা অসম্ভব। তাই এটি সহজেই অনুমেয়, যে কাজে যুক্ত হওয়া মানেই মৃত্যুর সাথে লুকোচুরি খেলার শুরু, সেই কাজ নিশ্চয়ই কোনও শরীর কেন্দ্রিক চিন্তার কাপুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়! 

এই সকল লড়াই, অত্যাচার, কষ্ট, সকল কিছু পেড়িয়ে এসেছি আমরা আজ ৭৩ বছর আগে। আমরা অনেকটা পথ এগিয়েছি, কিন্তু বাকি পথের পরিমাণ তার থেকে বহু বহু গুণ বেশী এবং বন্ধুর। ৭৩ বছর আগের লড়াই ছিল জাতিকে বাইরের শত্রুর হাত থেকে বাঁচানোর, কিন্তু এই লড়াই জাতি গঠনের। এ লড়াই আরও বেশী কঠিন। এ লড়াই নিজের সাথে নিজের। 

১৫ই আগস্ট ২০২০ - এর স্বাধীনতা দিবস পালনের ব্যতিক্রমী এক চরিত্র লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। এই প্রথমবার ভারতবাসী স্বাধীনতা দিবস পালন করছে গৃহবন্দী অবস্থায়, মহামারীর প্রকোপের কারণে। আবেগী মন পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, মিষ্টি মুখ করা ইত্যাদি বিষয়ের আভাব বোধ করতে পারে, তবে বাস্তব হলো ঘরে থাকা বা বাইরে যাওয়ার সাথে মুক্তির অনুভূতির সম্পর্ক তেমন কিছু নেই। পুরো বিষয়টাই মানসিক। আমাদেরও আজ সেই বিপ্লবীদের কথাই মনে রাখতে হবে -- আমরা ঘরে আটকে আছি, আমাদের চিন্তাধারা নয়। আমাদের কল্পনা নয়। বড় কথা হ'ল, আমরা আমাদের স্বার্থে গৃহবন্দী। আমাদের জাতির স্বার্থে। দশের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে। 

তবু যতটুকু আক্ষেপ আমাদের মনে থাকবে, বা অসন্তুষ্টি জন্ম নেবে তার পুরোটাই আবেগজনিত। একটি বিষয় জেনে রাখা দরকার, আজকের সময়টা আবেগজাত বুদ্ধির (Emotional Intelligence). আবেগজাত বুদ্ধির দুটি বড় দিক হ'ল -- ১. অন্যের আবেগ বা অনুভূতিকে বোঝার দক্ষতা এবং ২. নিজের আবেগের ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ। যাতে ভারসাম্য বজায় থাকে। যদিও এর আলোচনার ব্যাপ্তি বেশ বড়, তবু এই দুটি দিক বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আবেগজাত বুদ্ধিতে ধার দেওয়া আজ খুব জরুরি। এটি সামগ্রিক জাতির চরিত্র গঠনের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমাদের পূর্বসূরীরা আমাদের উপহার দিয়েছেন। এখন আমাদের দায়িত্ব হ'ল, ভারতবর্ষকে আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান করা। দৃঢ় করা। আজকে দরকার মানসিক সংকীর্ণতা আর গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হওয়ার। আগামী তৈরী হবে আজকের সিদ্ধান্তের ওপর, তাই এই দায় যেন আমরা এড়িয়ে না যাই! বাইরের জগতের ওপর দোষারোপ করাও এক জাতীয় দাসত্ব। বাইরের জগতের প্রতি দাসত্ব। আমাদের জীবন যদি বাইরের জগতের নিয়ন্ত্রক দ্বারা অনবরত নিয়ন্ত্রিত হতেই থাকে, এর অর্থ আমরা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের স্ব-অধীনতা নেই। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। সংযম নেই। আর এখানে এসেই স্বাধীনতা দিবসের সব আড়ম্বর ম্লান হয়ে যায়‌। পরিহাসে পর্যবসিত হয় স্বাধীনতা দিবস পালনের তাগিদ। 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours