দীপ্তি জামান, লেখিকা, বাংলাদেশ:

আমি বেড়ে উঠেছি গাঁও গ্রামে৷ দুরন্ত কৈশরের কতবেলা কেটেছে গাঁয়ের মেঠো পথে৷ দেখেছি কাঁচা সবুজে ঘেরা গ্রামের পর গ্রাম৷ গ্রামের ওপর ঝুলে থাকা ঘন নিলাভ আকাশ৷ যে আকাশে ছিল তুলার মতো দানা বাঁধা উড়ন্ত মেঘমেলা৷ দেখেছি রাতের পর রাত৷ নক্ষত্র খচিত রাত৷ জোনাকি রাত৷ কত রাত মাখামাখি হয়ে থাকত জোছনা আর হাসনাহেনায়৷ কতোবার দেখেছি বর্ষা, আষাঢ়ে ভরা নদী, খালবিল জলাশয় ৷ হেমন্তের শিশির, শীতের কুয়াশা, বসন্তের উদাস করা ফাগুন৷ কত রাত জেগে উঠেছি আধো শিহরনে ডাহুক ডাকা মধ্যরাতে৷ এভাবে রূপে-রসে-গন্ধে জড়িয়েছি বাংলাকে৷ পাশাপাশি এই সৌন্দর্য ও সুখী জীবনের বাইরে যে জীবন দেখেছি, তা ছিল দহন ও পীড়নের৷ নিত্যদিনের বিষয় বৈষয়িক ভিত্তিক জীবন ছিল জঞ্জালের৷ সেখানে দেখেছি সামাজিক ও ধার্মিক৷ দেখেছি সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদা বঞ্চিত শুদ্ধ মানুষ, যারা ছিলেন প্রকৃতির মতো সরল এবং তারা সামাজিক ও কথিত ধার্মিকদের কপটতা, স্বার্থপরতা, অন্যায়, অন্যায্যতা দেখে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছেন ধর্মীয় বিধি-বিধান ও সামাজিক প্রথাপদ্ধতি থেকে৷ বেছে নিয়েছেন সরল সুষমা মন্ডিত বৈপ্লবিক জীবন৷

কত সাধু-সুধীজন সুবিধা মতো নিজেদের তৈরি মনগড়া ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি-বিধান, নীতিমালা করে হয়েছেন ঈশ্বরে বিশ্বাসী আস্তিক। বিষয় সম্পত্তি যজ্ঞের ধনের মতো আগলে রেখেছেন ধর্মীয় আইনের দোহাই দিয়ে ৷ তারা মানুষে-মানুষে, জীবন-জীবিকায়, ভোগে-বিলাসে করছেন বিভাজন৷ বিত্ত-বেসাতে দেয়নি এক ইঞ্চি ছাড়৷ ধর্মীয় অজ্ঞতা, অন্ধত্ব আর দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা নিয়ে মানবিক গুনাবলী থেকে হয়েছেন উৎকর্ষচ্যুত৷ এরা নিয়তি নির্ভর জন্ম-মৃত্যুর বিধান-বিধির মাহফিক দুর্গের মধ্যে বসাবাস করতেই অভ্যস্ত৷ অথচ ঐ বিধান তাদের মননে প্রবেশ পথ পায় না৷ অদৃশ্য শক্তির অভেদ্য দূর্গে মানুষে-মানুষে, জাতে-জন্মে, ধর্মে-বর্ণে চলে দ্বেষ-দ্বন্দ্ব- সংকট-সংঘাত, দাঙ্গা-লড়াই, শোষণ-পীড়ণ৷ জাতি ধর্ম বর্ণ বিভাজনের ফলে তারা আদি আদিম প্রাণীর মতোই রয়ে গেছে প্রতিহিংসাপরায়ণ অযৌক্তিক জীবনাদর্শের বলয়ে৷

মানবিক মানে মুক্তির সন্ধানে ব্যাপৃত সত্তা৷ যারা শ্রম সহিষ্ণু দিয়ে গড়ে তোলে ছোট ছোট নীড়৷ দু:খ-দারিদ্রের মধ্যে খুঁজে সমৃদ্ধি৷ সরল সত্যের সুষমা দিয়ে কলুষিত অন্ত:বৃত্তে জেলে দেয় আলোর প্রদীপ৷ পতনের গভীরতর স্তর থেকে, নির্বাক নীরবতার স্তব্ধতা থেকে অধঃপতিতদের মনে আশার বীজ বপন করে৷ দিনময় আড্ডা দেয় নিজের সাথে, ডুবে যায় লাল নীল দীপাবলি আর কতো নদী সরোবরে৷ গলে যায় সুরের মূর্ছনায়৷ উজ্জীবিত হয় সফলদের স্বপ্ন গাঁথা নিয়ে৷ সুখী হয় ডাহুক ডাকা আধো সকাল আর ঝলমলে উজ্জ্বল দুপুর দেখে৷ পড়ন্ত বিকেলে আড়ি পেতে শোনে গোধূলির কথোপকথন৷ রঙিন খড়ির পেনসিলে আঁকা অনিপুণ হাতের  শিল্পকলা, হেলেঞ্চা সুষণি লতা গুল্মের দৃশ্যপটে খুঁজে পায় তৃপ্ত ছোঁয়া৷ কথিত ধার্মিক ও সামাজিকদের গৎবাঁধা দায়বদ্ধতা থেকে উৎপত্তি অন্যায় অন্যায্যতা দেখে চায় মুক্তি৷ খুঁজে প্রকৃত শিক্ষার মাঝে সফলতার সম্ভাবনা৷ জীবদ্দশায় স্বাক্ষর রেখে চলার চেষ্টা করে সাম্যবাদের৷

মনন চর্চায় সফল যারা, তারা নির্বিঘ্নে নিভৃতে সর্বমানবিক জীবনযাপনের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সমাজ-সংসারে৷ বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের চিত্রকর্মে বাংলার খেটে খাওয়া কৃষক দিনমজুরের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে৷ তিনি তার জীবদ্দশায় প্রাসাদ প্রাচুর্যের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেননি৷ মাটি আর মানুষের সাথে একান্ত আপন হয়ে থেকেছেন৷ পপ সম্রাট খ্যাত আজম খান সাদামাটা মানুষটি ব্যক্তিগত ও বাহ্যিকভাবে অতি অনাড়ম্ভর জীবনযাপন করে গেছেন৷ পার্থিব প্রলোভন -বিত্তবৈভব তাঁর মানবিক সত্তাকে গ্রাস করতে পারেনি৷ দার্শনিক আরজ আলি মাতুব্বর, ক্ষুধা-দরিদ্রতা যাঁকে দর্শন চর্চা থেকে লক্ষ্য ভ্রষ্ট করতে পারেনি৷ তাঁর দর্শন চর্চা ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিল প্রতিবাদ স্বরূপ৷ লোকশিল্পী সাহ আব্দুল করিম যাঁর স্বরচিত গানে, সুরে ও গাওকিতে মেতে থাকত গাঁয়ের জনপদ৷ যিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই বাংলার কাদা জলের সাথে মিলেমিশে পড়ে থাকতেন৷ কালজয়ী এই মানুষগুলো ছিলেন আধুনিক সাম্যের এক অনন্য রূপকার৷ বিত্তবিলাসের সাথে অভ্যস্ত না হয়ে সাম্যের রাজ্যে করেছিলেন রাজ৷ মনের গভীরে অন্তদৃর্ষ্টি দিয়ে সসীম আর অসীমের সাথে করেছিলেন রাজ৷ তাঁরা নির্মল ব্যক্তিত্ব আর পরিমিত জীবনবোধের সমন্বয়ে যে আদর্শের দৃষ্টান্ত রেখেগেছেন পৃথিবীতে, তা দেখে ভাবি, বরং মানুষই হবো৷


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours