ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তা প্রকৃতির অবদান। মানুষ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু মানুষ নিজেকে এই পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য নানান কিছু উদ্ভাবন করেছেন। মূল কথা হলো, মানুষ তার প্রয়োজনে সব কিছুই আবিস্কার বা সৃষ্টি করে থাকে। আবার মানুষ তার সৃষ্টিকে রক্ষণাবেক্ষনের জন্যও নানান রকমের কৌশল আবিষ্কার করে থাকে। যেমন মানুষ বেঁচে থাকার জন্য কৃষিকাজ শুরু করল। সময়ের প্রয়োজনে ধীরে ধীরে সেই কৃষিজাত শস্য যাতে আরো বেশি ফলন হয় তার জন্য সার আবিস্কার করলেন। আবার পোকা মাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে কীটনাশক আবিস্কার করলেন।

তেমনি প্রাচীন সভ্যতার যুগে মানুষ প্রথম যখন বুঝতে পারলো বা আবিস্কার করল ব্যক্তি জীবনে স্বর্ণমুদ্রা হচ্ছে সবচেয়ে দামি ধাতু। তখন সেই স্বর্ণমুদ্রা রাখার জন্য লোহার বড় বড় সিন্ধুক তৈরি করা হলো। যাতে সহজেই কেউ সেটা ছিনিয়ে নিতে না পারে। ঠিক একই ভাবে স্বর্ণমুদ্রা থেকে এক সময় স্বর্ণের অলংকার আবিস্কার করার প্রচলন হলো। আর মানুষ বুঝতে শিখলো স্বর্ণ হচ্ছে একটি দামি মূল্যবান ধাতু। এটা যার কাছে যত বেশি আছে, সেই ব্যক্তি তত বেশি ধনী। তাই এই স্বর্ণ যত্ন করে রাখার জন্য আলাদা করে জুয়েলারী বক্স বানানোর প্রচলন চালু হলো। যেটার নাম ছিল অলংকার সিন্ধুক। ঠিক একই ভাবে ডায়মন্ড, প্লাটিনামকেও মহামূল্যবান ধাতু হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়। যে ধাতু যত মূল্যবান তাকে ততবেশি দামী সিকিউরিটি দেওয়া হয়। যেমন বাজার থেকে কেউ যখন গোল্ড কিনে আনে, তা ড্রইং রুমে সাজিয়ে রাখে না কেউ। যত্ন করে আলমারিতেই তুলে রাখে। বা ডায়মন্ড কিনে আনলে তা আরো সতর্ক করে যত্নে রাখা হয়। 

দৈনন্দিন কাজে কম বেশি সকলকেই ব্যাঙ্কে যেতে হয়। একটু খেয়াল করলে দেখতে পাবেন সকল ব্যাঙ্কের গেটে একটা বন্দুক হাতে সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের বেশির ভাগই বয়স্ক, শীর্ণকায়। তাদের দেখলেই বোঝা যায় তাদের বেশির ভাগই অসুস্থ। এরা অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারি। এদের বেতন খুবই সামন্য। সারাদিন হয়তো আধপেটা খেয়ে কোনমতে দিনযাপন করে। বয়সের ভারে শরীরে নানা রকমের অসুখ বাসা বেঁধেছে। সামান্য বেতনে পেটের ভাত জোগাড় করাই যেখানে কঠিন, সেখানে ওষুধ কেনা বিলাসিতা ছাড়া আর কি হতে পারে। আমরা সকলেই জানি ব্যাঙ্কে প্রতিদিন অনেক টাকা লেনদেন হয়। এখানে প্রতিদিন হাজার মানুষের আনাগোনা। কে কোন মতলবে আসে তা বুঝতে পারা কঠিন। বেসরকারী ব্যাঙ্কে তবু সিসিটিভি থাকে। সরকারী ব্যাঙ্কে সিটিটিভি দেওয়া হলেও তার অধিকাংশই থাকে অকার্যকর। কারন সরকারী অফিসে পদমর্যাদা এবং বেতন বৃদ্ধি হয় তড়িৎ গতিতে। বাকি সবই ধীরগতিতে। মাঝে মাঝেই ব্যাঙ্ক ডাকাতির খবর শোনা যায়। এখন প্রশ্ন হলো, এত টাকার লেনদেন হওয়া ব্যাঙ্কের পাহারাদারের যদি এই হাল হয়। তাহলে ব্যাঙ্ক ডাকাতি হওয়া কি খুব আশ্চর্যের বিষয়? যদি শক্তিশালী ৪/৫ জন জোয়ান ব্যক্তি স্বশস্ত্র হয়ে আসে, ওই সিকিউরিটির দ্বারা কি সম্ভব তাদের প্রতিহত করা? ব্যাঙ্কের দায়িত্বরত অফিসার থেকে কর্মচারিদের জীবনের নিরাপত্তাইবা কোথায়? 

রাস্তাঘাটে এটিএম বুথগুলিতেও এ রকম বয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ব্যক্তিদের অবস্থা আরো দুরূহ। কারন রাস্তার উপর নির্মিত এসব বুথে নেই বিশ্রামের সুবিধা। এমনকি পর্যাপ্ত জল এবং টয়লেট সুবিধা নেই। 

অনেক টাকা খরচ করে বড় বড় ভবণ নির্মান করা হয়। কিন্তু সেই ভবণের নিরাপত্তার জন্য সামান্য বেতনের দুজন সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের অধিকাংশই পেটের দায়ে কাজ করতে আসে। অসহায় এসব মানুষ বেঁচে থাকার জন্য হন্যে হয়ে একটা চাকরি খোঁজে। গরমের দিনে মানুষ যখন এসির মধ্যেও গরম অনুভব করে। তখন মোটা গরম পোশাক পরে সারাদিন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এ সব সিকিউরিটি গার্ডদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা নাই। এমনকি পানীয় জলেরও ব্যবস্থা থাকে না। যে নিজের সংসারের সিকিউরিটি নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তিত থাকে। তার দ্বারা বিলাসবহুল ভবণের সিকিউরিটি কিভাবে আশা করা যায় ? নাইট গার্ডদেরও একই অবস্থা। দিনে অন্য কোথাও কাজ করে। অতিরিক্ত আয়ের জন্য তারা রাতে ডিউটি হিসাবে এসব ভবণে চাকরি নেয়। রাতের ডিউটি বলতে রাত ৬টায় বা ৭ টায় এসে যোগদান করে। রাত ১১টার মধ্যে গেট বন্ধ করে গেটের ভিতরে গ্যারেজের কাছে লম্বা বেঞ্চ বা মেঝেতে মাদুর পেতে ঘুমিয়ে থাকে। সারাদিনের কর্মক্লান্ত দেহ রাত নামতেই ক্লান্তি ভর করে। যে কারণে প্রায়শই ভবণে চুরি বা ডাকাতির ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। বাড়ির মালিক কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিলাস বহুল বাড়ি নির্মান করে। তারপর তাতে আবাসিক বা অফিস ভাড়া দেয়। মাসে মাসে মোটা অঙ্কের টাকা ভাড়া পেলেও সিকিউরিটি গার্ডের বেলায় টাকা খরচ করতে রাজি না। এগুলো আসলে আমাদের দেশের সিস্টেমের রেজাল্ট। এই সিস্টেমের শিকার হয়ে অনেকে সর্বস্ব হারিয়েছেন। অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডের হাতে মালিক বা ভাড়াটিয়া খুন হওয়ার ঘটনা অহরহ শোনা যায়। গুলশানে এক চীনা ব্যবসায়ীকে বাড়ির দুই সিকিউরিটি গার্ড খুন করে লাশ গুম করেছিল। নিজের একটুকরা জায়গা থাকলেই বাড়ি বানানো শুরু করে দিচ্ছে। যেখানে যাওয়া আসার মতো রাস্তা আছে কিনা সেটা দেখার মতোও কেউ নাই। অনেক বাড়িতে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস আসার মতো রাস্তা থাকে না। নেই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। ভবনের ইনসিওরেন্স থাকার কারণে বাড়িওয়ালারা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন। কিন্তু ভাড়াটিয়াদের জন্য ক্ষতিপূরণের কোন ব্যবস্থাই থাকে না। যুগ যুগ ধরে এ অনিয়ম চলে আসছে। এ অনিয়মের বেড়াজাল থেকে বের হবার কি কোন রাস্তা নেই?


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours