রণজিৎ গুহ, লেখক ও সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

আমাদের বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞজনেরা, আমাদের অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শ্রমিকনেতা, লেখক এবং আমজনতার অনেকেই স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তো বটেই বছরে অন্য সময়েও ,কেউ ঠোঁট উলটে, কেউ কাঁধ ঝাঁকিয়ে, মাথা নাড়িয়ে, আঙুল তুলে কেউ মৃদু স্বরে, কেউ ফিসফিসিয়ে, কেউ উচ্চ কন্ঠে আমাদের জানান দেন যে আমাদের দেশ প্রকৃত স্বাধীন নয়। কারো গলায় আক্ষেপ, কারো গলায় হতাশা। কারো কারো গলায় হুঙ্কার। অতি বৃদ্ধ কেউ কেউ বলেন এর চেয়ে বৃটিশ শাসন ভাল ছিল। কি চেয়েছিলাম আর কি পেলাম? ইতিহাস সচেতনার ভান করে কেউ কেউ বলেন শুধুমাত্র ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে স্বাধীনতা পাইনি। অনেকে বিশ্লেষকের ভুমিকায় জানিয়ে দেন আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি, ব্যস ঐ পর্যন্তই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাইনি। এ আজাদী ঝুটা হল্লাবোল এখনো যে পুরো স্তিমিত তা বলা যায় না।

আমার ধন্দ ঐ ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ শব্দ দুটি নিয়ে।আমাদের দেশ যথাযথ স্বাধীন নয় বলে যারা গলা ফাটান তাদের কেউই প্রকৃত স্বাধীনতা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেননা। খোলসা করেন না। প্রাঞ্জল করেন না। কোন নমুনা পেশ করেন না। রাস্ট্রসঙ্ঘ স্বীকৃত প্রায় দুশো দেশের মধ্যে কোন দেশটি এই সব প্রাজ্ঞজনেদের মতে প্রকৃত স্বাধীন জানতে পারিনা। কিছু আন্তর্জাতিক ভাবনার মানুষজন অবশ্য ‘দেশ’ ধারণাটিরই বিরুদ্ধে। দেশ মানে অবশ্যই শুধুমাত্র একটা ভৌগলিক সীমানা নয়। দেশ মানে তার অধীবাসীরা। যে কোন দেশে মানুষজন কোন না কোন শাসন ব্যাবস্থার অধীন। কোথাও রাজা উজির, কোথাও বিদেশী শক্তি, কোথাও আম জনতার নির্বাচিত সরকার তৈরীর সুযোগ, কোথাওবা গোষ্ঠি নির্বাচিত প্রশাসকমণ্ডলী। যাকে বলি সরকার। সরকারের কাজকর্ম নীতি নির্ধারন নিয়ে আমাদের হাজার মতামত। আমাদের প্রত্যাশার যেমন শেষ নেই সরকারের সীমাবদ্ধতারও অবধি নেই। সরকার যদি আমার পছন্দসই রাজনৈতিক দলের না হয় তবে সেই সরকারের কোন ভাল কাজই আমাদের নজরে পড়ে না। আবার পছন্দসই দলের সরকার হলে তাদের সব অপকর্মের সাফাই দিতে শুরু করি। যে কোনও পরিস্থিতিতেই সরকারকে দায়ী করি। সরকার ও দেশ ঘুলিয়ে ফেলি। আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ম্ভর একথা স্বীকার করলে কোনও না কোন সরকারের প্রশস্তি  হয়ে যায় এবং আমার প্রিয় দলের বাড় বাড়ন্ত ব্যাহত হওয়ার ভয় থাকে। অতএব স্বাধীনতার পর আমাদের অগ্রগতির পিছনে বিদেশী শক্তির উদ্দেশ্য খুঁজে বেড়াই। আবার খাদ্যে স্বয়ম্ভর হওয়া সত্বেও অভুক্তর অভাব নেই। সে আমাদেরই অবহেলায়। আমরা প্রকৃত স্বাধীন নই বলে দায় এড়াই। প্রাজ্ঞজনেরা আমাদের জানান না কোন স্বাধীন দেশে যুদ্ধপ্রস্তুতি থাকেনা।

স্বাধীনতা আন্দোলনে ডাক এসেছিল ইংরেজ বিতারণই অগ্রাধিকার। এমনকি বলা হোল education may wait freedom not. এখন আমরা অগ্রাধিকার ঠিক করতে তর্ক জুড়ে দিই যোগাযোগ না স্বাস্থ্য ? ক্রীড়া না প্রতিরক্ষা? শিক্ষা না কৃষি? কোথাও না কোথাও খামতি থেকেই যায়। আমরা আলটপকা বাজার মাত করতে এই অসাম্যর জন্য প্রকৃত স্বাধীনতার কল্প পুতুলটি ঝুলি থেকে বের করি।

ব্যক্তি স্বাধীনতা বা গনতন্ত্র এবং উন্নয়ন বা সমাজবাদ এই দুইয়ের একটিকে বেছে নিতে বললে প্রায় সকলেই দানাপানি পাওয়া খাঁচার পাখী ও মুক্ত বিহঙ্গর গল্পর উপমা দিয়ে গনতন্ত্রের পক্ষে সায় দেন। অথচ পড়শি দেশের সঙ্গে তুলনায় সে কথা বলেন না। তখন কেবল উন্নয়নের কথাটুকুই সার। এবং ওই ঝোলার ওই প্রকৃত স্বাধীনতা নিয়ে বাগ বিস্তার করেন। স্বাধীন মানে স্ব নিয়ন্ত্রানাধীন। এই নিয়ন্ত্রন কিসের? ব্যাক্তি স্বার্থের নিয়ন্ত্রন। কাকে বলে স্বাধীকার? অন্যের অধীকারে তা কতটা হস্তক্ষেপ করে? 

স্বাধীনতা আন্দোলন আর বিচ্ছিন্নতা বাদী আন্দোলনের ঠিক তফাৎটা কি? স্বাধীন করদ রাজ্য নিজামের ভারত ভুক্তিতে হায়দ্রাবাদের মানুষরা স্বাধীন হোল না তাদের স্বাধীনতা হরণ করা হোল? চীনের আগ্রাসনের আশঙ্কায় সিকিম বা পাকিস্থানের দখলদারীর ভয়ে কাশ্মীর রাজের ভারত ভুক্তিতে অঞ্চল দুটির মানুষজন কি স্বাধীনতা হারালেন? তিব্বত এর মানুষদের লড়াই স্বাধীনতা জন্য? নাকি নিছক বিছিন্নতা বাদী ঝোঁক? সোভিয়েত রাসিয়া থেকে বেরিয়ে আসা দেশগুলি কি স্বাধীন হোল? এতদিন পরাধীন ছিল? তিব্বত, হায়দ্রাবাদ সিকিম কাশ্মীর সোভিয়েত ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা অঞ্চল গুলির এই সব মানুষেরা প্রকৃত স্বাধীনতা বলতে কি বোঝেন? আমাদের দেশের ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’বাদীরা সে বিষয়ে রা’ কাড়েন না। আমাদের সমাজের নানা বৈষম্য, অনাচার, অভাব ইত্যাদি আমাদের দুঃখিত করে। ব্যথিত করে। আমাদের ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করে। তাই বলে আমাদের দেশ স্বাধীন নয় এমন বলার মধ্যে প্রকৃত পক্ষে নানা রঙের বিদেশী জুজু দেখিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা হয়।স্বাধীন দেশের নাগরিক দায়িত্ব নির্বাচনে নিজ দলকে ভোটে জেতানোর মধ্যেই সীমিত রেখে সরকারে আসীন হওয়ার মতলবেই দেশের স্বাধীনতাকে হেয় করা হয়। দেশাত্ববোধকে ঠাট্টা করা হয়। দেশ বোধকে অপ্রয়োজনীয় দেগে দেওয়া হয়। নিজেদের আত্মবিশ্বাস প্রত্যয়কে হীনবল করে তোলা হয়। এবং এভাবেই আমাদের দেশকে দুর্বল করে অন্য নির্ভর করে তোলার পথে পা বাড়াতে সাহায্য করে।

স্বাধীন ভারত জিন্দাবাদ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours