সুরঞ্জন কর, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

আজ সকাল থেকে আসিফের ডান কানটা কটকট করেই চলেছে, এটা কিন্তু মোটেই ভালো লক্ষণ নয় I যতবার এই কটকটানি হয়েছে, ততবারই একটা ভালো হতে চাওয়ার ভূত, কোত্থেকে কে জানে ঘাড়ে চেপে বসেছে আর সে ভারী কষ্টের ব্যাপার ও বটে I আরে বাবা, আসিফ তো এক সামান্য গরিব মানুষ, নেহাত হাতের কাজটা এখনো ঠিকঠাক করতে পারে তাই দিন চলে যাচ্ছে কোনও রকমে, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ এই ভালো হওয়ার ভূতে ধরলেই সব বরবাদ I ও খেয়াল করে দেখেছে, বয়েস যত বাড়ছে, এই কটকটানিটাও যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছেI

দু কানে তেল দিয়ে, বেশ কবার কানের লতিদুটোকে টেনে টেনে দেখলো - নাঃ, কোনো লাভ হলো না I এরকম দিনে বাড়ি থেকে বেরোলে, দু পয়সা আয় তো হয়ই না, উল্টে গ্যাঁটের টাকাও জলে যায় I আজ আর বেরোবেনা ঠিক করে চুপচাপ কিছুক্ষন চিৎপাত হয়ে শুয়ে রইলো কিন্তু আধঘন্টা যেতে না যেতেই আরেকটা অস্বস্তি শুরু হলো ... খিদে পাচ্ছে I দেওয়ালে ঝোলানো জামার পকেট হাতড়ে যে পেলো, তাতে একবেলা চালিয়ে নেওয়া যাবে, তারপর ? অগত্যা বেরোতেই হবে, দেখাই যাক কি আছে কপালেI

এখন বেলা সাড়ে এগারোটা বাজতে চললো, অফিস টাইম শেষ তাই বাস ও একটু কম I একটু অপেক্ষা করতেই একটা বাস পেয়ে গেলো, বেশ ভিড়, তবে তাতে আসিফের কোনো অসুবিধা নেই I ভিড়ের গুঁতো খেতে খেতে বাসের মাঝামাঝি এসে, এক হাতে একটা কাটা সিটের পিঠ আর অন্য হাতে মাথার ওপরের রড ধরে দাঁড়ালোI

বাসটা যেন যেতেই চাইছে না, থেমে থেমে ঢিকিস ঢিকিস করে কোনোক্রমে চলেছে I বাসের দাঁড়ানো লোকেদের অবস্থা সত্যিই কাহিল, একে বাইরে এই গরম, তার ওপর ভেতরে এমন চাপাচাপি ভিড়, একটু হাওয়াও আসছে না I সামনের সিটে বসা মাঝবয়েসী লোকটা এর মধ্যেই ঘুমিয়ে কাদা, ঘুমের ঘোরে বারে বারে আসিফের গায়ে ঢলে পড়ছে আর প্রতিবার আসিফ ওনার কাঁধ ধরে সোজা করে বসিয়ে দিচ্ছে I আসিফের ডান পাশে এক বয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে, ওনার পরনের পাঞ্জাবিটা ঘামে জবজবে হয়ে গায়ে সেঁটে আছে, দরদর করে ঘামছেন আর ঘনঘন রুমালে মুখ মুছছেন, বাসটা মোটে চলছেই না, তাও যেন ওনার দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে; টলমল করে বার দুয়েক পড়ার উপক্রম হয়েছিল, আসিফ ধরে দাঁড় করিয়েছেI

হাজরা আর ল্যান্সডাউনের মোড় এসে গেছে , এবার আসিফের নামার সময় I কানের কটকটানিটা অনেকটা কম ... কিন্তু আছে I হাসপাতালের উল্টোদিকে ফুটপাথের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে একটা বিড়ি ধরাবে ভাবছে, হঠাৎ একটা হৈহৈ আওয়াজ আর প্রায় চলতে না চাওয়া বাসটা এবার সত্যি সত্যিই থেমে গেলোI আসিফ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছে, তবে কি ? .... তেমন হলে রাস্তা পেরিয়ে হাসপাতালে ঢুকে গেলেই হলো ... না, এ অন্য ব্যাপার, বাসের যাত্রীরা ওর পাশে দাঁড়ানো ওই বুড়োটাকে ধরাধরি করে নামিয়ে আনছে, বুড়োটা কি মরে গেলো নাকি ? কানের কটকটানি মারাত্মক বেড়ে গেছে, আসিফ পায়ে পায়ে গিয়ে ভিড়ের পাশে দাঁড়ালো, শুনলো সবাই বলাবলি করছে ভদ্রলোক মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন, এরা সামনের হাসপাতালেই নিয়ে যাচ্ছেI ভদ্রলোকের পাঞ্জাবির ফাঁক দিয়ে পৈতে দেখা যাচ্ছে, ঘোলাটে চোখ দুটো আধবোজা, সাত আটজন যাত্রীর হাতের দোলনায় শুয়ে শুয়ে চলেছেন বৃদ্ধ I কোনো কিছু না ভেবে আসিফ ও হাত লাগায়, চলতে চলতেই জিজ্ঞেস করে, 'নাম, ঠিকানা কিছু জানেন কেউ ? কিছু বলেছেন উনি ?' নাম শুনলো অমল ঘোষাল, উত্তম মঞ্চের পাশে ওনার বাড়ি,পুরো ঠিকানা বলার আগেই জ্ঞান হারিয়েছেন। 

হাসপাতালে এমার্জেন্সির দিকে চললো সবাই, আসিফের এবার আলাদা হওয়ার পালা I উফ ... কানের কটকটানিটা বড্ডো জ্বালাচ্ছে ... সবার আগে একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার ...I

পনের মিনিট লাগলো অমল বাবুর বাড়ি যেতে, ভাঙাচোরা টালির বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে যিনি দরজা খুললেন ... আসিফের নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো ... সেই এক মুখ ... এক চেহারা ... মায়ের চিরন্তন রূপ ...I পাড়ার ছেলেরা খুব ভালো, ওরাই বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছিলো, এখনো সাথেই আছে I কানের অস্বস্তিটা এখন দুকানেই ছড়িয়ে গেছে, আসিফ অমল বাবুর মানিব্যাগটা ওনার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বলে, ' মা, এটা ওনার পকেট থেকে পড়ে গেছিলো, ভিড়ের মধ্যে কে নিয়ে পালাবে তার নেই ঠিক, আমি সাবধানে রেখে দিয়েছিলাম...

একটু দেখে নিন ভেতরে সব ঠিক আছে কিনা ...I ' ভদ্রমহিলা পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে আছেন, শক্ত করে ধরা আসিফের দুটো হাত ওনার চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে, অস্ফুটে বললেন, ' ভগবান আছে বাবা... ভগবান আছে ..' I

মিনিট পনেরো পরে আসিফ আবার রাস্তায় এসে দাঁড়ালো I অমল বাবুর স্ত্রী পাড়ার ছেলেদের সাথে হাসপাতালে গেছেন, আসিফকে বারবার করে এসে ওনাদের খোঁজ খবর নিতে বলেছেন I আসিফের এখন অনেক হালকা লাগছে , অমল বাবুর মানিব্যাগে ছিল তিনশো টাকা আর কিছু খুচরো আর ওই বাসের ঘুমন্ত লোকটার ব্যাগে ছিল হাজার I হাসপাতালের বাথরুমেই অমল বাবুর ব্যাগে সেই হাজার ভরে দিয়েছিলো, ঘুমন্তর মানিব্যাগ এখন হাসপাতালের জানালার বাইরে আবর্জনার স্তুপে I নাঃ … ভালোমানুষির ভূত আজও ওকে দিয়ে ভালো কিছু করিয়েই ছাড়লোI

বাস রাস্তায় উঠতেই টের পেলো জোর খিদে পাচ্ছে আর সকালের সেই কান কটকটানিটাও আর নেই ... যাক বাবা ... নিশ্চিন্ত... ঢের ভালোমানুষি হয়েছে, এবার নিজের কথা ভাবতে হবে ... একটা বাস আসছে ... বেশ ভিড় ... আসিফ হাত দেখাতেই গতি কমায় বাস ... দু পা দৌড়ে টুক করে উঠে পড়ে বাসের ভিড়ে মিশে যায় আসিফ ... এবার নতুন শিকার খোঁজার পালা ...I

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours