অমৃৃত রঞ্জন গোস্বামী, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

অবতার কে? উত্তর হ'ল -- যিনি অবতরণ করেছেন। কোথা থেকে অবতরণ করেছেন? তিনি অসীম থেকে সসীমে অবতরণ করেছেন। কেন করেছেন? কারণ সৃষ্টিতে অস্থিরতা তৈরী হয়েছে। শক্তির সামঞ্জস্য নষ্ট হলে, অবতারকে পালন কর্তা হিসাবে আসতে হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হ'ল, পরমাত্মার এই সৃষ্টিতে কিছু দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে মানুষের রূপ নিতেই হয়। মানুষ রূপটি হ'ল একটি মাধ্যম, যার দ্বারা কার্য সিদ্ধি হয়। একপ্রকার বলতে গেলে, কার্য সিদ্ধির জন্যই অবতারের প্রয়োজন। এই সৃষ্টির মাঝে মানুষের গুরুত্ব অনেক। অবতারের মানুষের শরীর ধারনের বৈশিষ্ট্য হ'ল -- তিনি মানুষ ভাবে যেমন সত্য, অনুরূপভাবে তিনি আবার চিন্ময় সত্ত্বাতেও সত্য।

শ্রীকৃষ্ণও একজন অবতার। আজ তাঁর জন্ম জয়ন্তী। এখন আবার প্রশ্ন হ'ল, এই "জয়ন্তী" কথার অর্থ কি? উৎস কি? 

শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথির মাঝ রাতে যে রোহিনী নক্ষত্রের উদয় হয়, সেই উদয়ের নাম "জয়ন্তী"। ঠিক সেই সময়েই শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়। এই বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, তাঁর জন্মোৎসব তিথির উদযাপনের নামকরণ হয়, শ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী। কিন্তু এই শব্দের ব্যাপকতা এমন হারে বাড়ে, তখন যে কোনও জন্মোৎসব বোঝাতেই "জয়ন্তী" শব্দের প্রয়োগ শুরু হয়। এবং আজ আমরা দেখতেই পাই যে "জয়ন্তী" শব্দের ব্যবহার আরও না জানি কত ক্ষেত্রে অহরহ হয়ে চলেছে! 

এমনকি "জয়ন্তী" শব্দের প্রয়োগ কোনও গ্রন্থের জন্মোৎসবের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয় -- গীতা জয়ন্তী। আবার ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রেও -- তুলসী জয়ন্তী; বিদ্যাপতি জয়ন্তী; শিবাজী জয়ন্তী প্রভৃতি। আবার নির্দিষ্ট সময় অতিক্রমকারী কোনও বিষয়ের ক্ষেত্রে -- রজত জয়ন্তী, সুবর্ণ জয়ন্তী ইত্যাদি। 

বিশিষ্ট পন্ডিত শ্রী অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ মহাশয় বলছেন, জন্মাষ্টমীর দিন সব থেকে বেশী আকর্ষক ঘটনা হ'ল ঢাকা নগরীর রাস্তায় জন্মাষ্টমীর মিছিল। ওই দিন সকলে উপবাস করেন ওখানে। এই উৎসব মুখরতা তথায় আজও বর্তমান কি না জানি না, তবে ঢাকা যে এক ঐতিহ্যময় স্থান তা অনস্বীকার্য! 

সনাতন শাস্ত্র মতে, শ্রীকৃষ্ণ অবতার হলেও তিনি সব সময় অবতীর্ণ হন না। তিনি অংশে বা আবার অংশেরও অংশ মাত্র হয়ে অবতীর্ণ হন। এই কারণে অবতারদের মধ্যে তারতম্য ঘটে। কোথাও বারো আনার প্রকাশ তো কোথাও চোদ্দ আনার! এই কারণে শ্রীকৃষ্ণ অন্যান্য সকল অবতারের সাথে এক সারিতে অবস্থান করেন না! তিনি আদতে সব অবতারের মূলস্বরূপ অবতারী।

উপসংহারে বলি, কেবল ব্যক্তি পুজো নয়, এই দিনটি শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষার প্রয়োগের মাধ্যমে পালিত হওয়া বড় আবশ্যিক। শ্রীকৃষ্ণের নামের সাথেই যে নাম লেজুড় হিসাবে স্বাভাবিকভাবে মাথায় আসে আমাদের, তা হ'ল -- শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতা। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় শ্লোক আমাদের সমাজ জীবনের জন্য আজ বড় প্রাসঙ্গিক এবং একই সাথে আবশ্যিক। 

শ্লোক:

"ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্যতে।

ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।" 

অনুবাদ: হে পার্থ! ক্লীবতা প্রাপ্ত হয়ো না, এ তোমার উপযুক্ত নয়। হে পরন্তপ! ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য ত্যাগ করে (যুদ্ধার্থে) ওঠ।

* পার্থ: পৃথার পুত্র, তাই অর্জুনের আর এক নাম, পার্থ। পৃথা কুন্তির অপর নাম।

* পরন্তপ: শত্রুকে তাপ প্রদানকারী। যিনি শত্রুকে পীড়া দেন। 

এই শ্লোকটিকে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন -- "গীতার সার"। বিবেকানন্দের মতে, এই দুনিয়ার সকল দুঃখ আর পাপের কারণ হ'ল এই হৃদয় দৌর্বল্য। এই মন্তব্যটি তর্কাতীত। 

 আমরা হৃদয়ের এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে সিংহনাদের সাথে এগিয়ে যেতে পারলে, সেটাই হবে প্রকৃত "জন্মাষ্টমী" পালন।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours