অরুন্ধুতী সেনগুপ্ত, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

"মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়।" 

— সমরেশ মজুমদার                               

'মৃত্যু' একটি চিরন্তন সত্য; এমন একটা সত্য যা আমাদের সবাইকে একদিন বরন করতে হবে।আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানের দ্বারা এই রহস্য উন্মোচন সম্ভবপর হয় নি।       

কখনো নিজের চোখের সামনে মৃত্যু পথযাত্রীকে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে দেখেছো? কখনো নিজের চোখে শ্মশানে কোনো বডি পুড়তে দেখেছো?

যে তুমি হালকা ধূপ বা সিগারেটের ছ্যাঁকায় পড়া একটি ছোট্ট ফোঁসকার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবার জন্য ওষুধ লাগিয়েছো সেই শেষদিন তোমার অচেতনে আগুনের তাপে তোমার শরীরে শত শত ফোঁসকা ফুলে উঠবে আর সশব্দে ফাটবে রক্ত ছিটিয়ে।

একটু মাথার ব্যাথায় যেদিন শত কাজ ফেলে রেখে ল্যাদ খেয়েছিলে ঘন্টার পর ঘন্টা, শেষদিন মাথাটাও শেষে পুড়বে না বাঁশ দিয়ে মেরে ফাটাবে শাস্ত্রমতে।

একদিন এতো সাজ পোশাক মেকাপের যত্ন। শেষদিন তোমার অলক্ষেই তোমার গা থেকে সবটুকু টেনে খুলে নগ্ন করে চিতায় চাপাবে।

একদিন গরম খেতে পারতে না বলে মা বা বাবা ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে দিতো, শেষদিন সেই মাকেই বাবাকেই তার ছেলে জলন্ত অগ্নি মুখে ঢুকিয়ে মুখাগ্নি করবে।

কখনো সচক্ষে কবরে কাউকে মাটির ভিতরে যেতে দেখেছো?

লেপের মধ্যে পাঁচমিনিট থাকলে যেখানে তোমার একদিন দম বন্ধ হয়ে যেতো শেষদিন চিরজীবনের জন্য তোমায় মাটির ভিতরে চলে যেতে হবে। যেখানে একবিন্দু হাওয়া প্রবেশ করবে না। পোঁকায় ছিঁড়ে খাবে কুঁড়ে কুঁড়ে পচা গলা দেহটাকে।

ভাবলেই গা শিউড়ে উঠবে, তখন এই লেখাটির বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করতে ইচ্ছে করবে।

কারণ আর তুমি কোনোদিন পারবে না ফিরে আসতে, পারবে না ধর্মতলা বা গরিয়াহাটের মোরে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে, পারবে না বিরাট কোহলির ব্যাটিং দেখতে, পারবে না বয়ফ্রেন্ডের সাথে মন খুলে ঝগড়া করতে, পারবে না দুর্গা পুজোর পাঁচটা দিন হৈ হৈ করে বাঁচতে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, মায়ের হাতের শাঁখা পলার আওয়াজ, আলু পোস্ত ভাত, বাবার চশমা লুকিয়ে মজা করা, এসব আর তুমি পারবে না।

আজো মনে হয় সিগারেটটা ছেড়ে দিই, মদটা ছেড়ে দিই, যদি দুটো দিন বেশি বাঁচি।

আজও মনে হয় রাস্তার ফুটপাতটাই বেস্ট, হোকনা ভীড়, কিংবা গাড়িটা পেড়িয়ে যাক তারপরেই পেরোবো, হোক না পাঁচ মিনিট লেট। আরো তো কটা বছর এক্সট্রা পাবো।

আজো মনে হয় বাইকের স্পিডটা কমাই, কি হবে মেয়েদের কেদ্দানি দেখিয়ে? আরও তো কটা মাস এক্সট্রা পাবো।

আজও ভয় হয় হসপিটাল গেলে আর যদি ফিরে না আসি?

রোজ রাতে ঘুমোতেও ভয় পাই, যদি সকালে না উঠি?

আজো মনে হয় মানুষ নয় কচ্ছপ হয়ে জন্মালে পৃথিবীটা ৩০০ বছর এক্সট্রা দেখতে পেতাম।

প্রত্যেকটা দিনের সূর্যাস্ত মানে কি জানেন? আপনার জীবনের মোট দিন সংখ্যা থেকে একটি দিন শেষ হয়ে গেল।

ঘড়ির টিক টিক মানে কি জানেন? আপনার মৃত্যুর সেই সন্ধিক্ষণ যা ক্রমশ এগোচ্ছে। এবার আপনার ভাগ্যে বেঁচে থাকার কতটা সময় বেঁধে দেওয়া আছে সেটা আপনি জানেন না, হয়তো একশো বছর অথবা আগামী একমাস, একদিন অথবা এক ঘন্টা। এর থেকে বড় সাসপেন্স আর কিছুই হয় না।

মৃত্যু আসছেই, তবে কতটা স্পীডে সেটাই কৌতুহল, আসল কথা হল আমরা সবাই স্বর্গ সুখ চাই, কিন্তু কেউ স্বর্গে যেতে চাই না। তাই বেঁচে থাকার লড়াই। সুইসাইড যে করে সে কাপুরুষ নয় বস্, অন্তত আমি মনে করি, দম না থাকলে মৃত্যুভয়কে আয়ত্তে আনা যায় না। আপনি করে দেখান তো দেখি, পারবেন না। "সুইসাইড যারা করে তারা কাপুরুষ বা নরকে জায়গা হয়, কিংবা এটা পাপ" এই প্রবাদ গুলো সৃষ্ট শুধুমাত্র একটি মানুষকে সুইসাইড থেকে বিরত রাখার জন্য আর কিছুই না। কারণ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার পর সেই লাস্ট দুমিনিট আপনি বুঝে যাবেন জীবন কি? কতটা কষ্ট হয় প্রাণ বেরোতে? সেই দু মিনিট আমি হলফ করে বলতে পারি আপনার গার্লফ্রেন্ড, আপনার মা-বাবা, আপনার ফেল করা মার্কশিট কিংবা যার জন্যই সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন আপনার মাথাতেই আসবে না। পা ছুঁড়তে থাকবেন শুধু নিজেকে বাঁচাতে।

তাই যতটুকু সময় আমরা বেঁচে আছি একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারি না? মা-বাবার সাথে তর্কবিতর্ক ঝগড়াটা একটু বন্ধ করতে পারি না? বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ করব কি না, আর একবার ভেবে দেখতে পারি না? জীবনটা তো একটু, তাই না বলুন? হাতে সময় খুব কম, একটু মিলেমিশে থাকতে পারি না সবাই?

জীবনের অন্তিম তাকেই তো মৃত্যু বলি? এই বিষয়ে নিজেরই কৌতূহল অপরিসীম, এই নিয়ে আরো অনেক কিছু লিখার অভিপ্রায় আছে। কারন এটি আমাদের সবার সাথে একদিন না একদিন পরিচয় করতে আসবে, সাক্ষাৎ ঘটবে। এই 'করোনা'র মত, ধনী-গরীব ভেদাভেদ হীন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শেষ ঠিকানা। আমার মনে হয় আমাদের সবার উচিৎ মৃত্যু আসার আগেই আমরা এই সমাজের জন্য আমাদের পরিবারের জন্য এমন কিছু করে যাই যা আমরা মরার পরেও থেকে যাবে। মৃত্যু চিরন্তন সত্য। এটা থেকে মুক্তির উপায় কারো নেই ।      

কবির কথায়- "জন্ম যেথা হউক সেথা কর্ম হউক ভালো" 

আজ এটুকুই থাক। আমি আমার কলম আঁকিবুকি প্রায় শেষ হবো হবো। লেখাটা লিখতে লিখতে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে। যদি এই লেখার মর্ম কেউ বুঝতে পারেন অবশ্যই আমি কৃতজ্ঞ হবো। কারণ আপনার সহানুভব হয়তো কিছু মানুষকে জীবন সম্পর্কে সচেতনতা দিতে পারে, রাজনৈতিক হিংসা খুনোখুনি কিছুটা হলেও বন্ধ করতে পারে, চিকিৎসা উন্নতি কিছু হলেও ঘটাতে পারে, জীবনের মূল্য তো সবার বোঝা উচিৎ। তাই নয় কি? দাঁত থাকতে যেমন দাঁতের মর্ম বুঝি না, বাবা-মা থাকতে তাঁদের মূল্যায়ণ করি না, ঠিক তেমনই জীবন থাকতে তার মূল্য ও নির্ধারণ করতে পারি না। জীবন ফুরালে বাকি সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়, স্রেফ একটাই সত্যি তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে মানুষটা আর নেই।                        

"মৃত্যুই আমাদের সবার গন্তব্য। কেউ কখনো এটা থেকে পালাতে পারেনি। এবং সেটাই হওয়া উচিৎ, কারন মৃত্যুই সম্ভবত জীবনের অন্যতম বড় আবিষ্কার। এটা জীবনে পরিবর্তনের এজেন্ট। এটা পুরনোকে ঝেড়ে নতুনের জন্য জায়গা করে দেয়।" 

— স্টিভ জবস


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours