সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

আমাদের মানব শরীরে যে ছয়টি ইন্দ্রিয় আছে তার মধ্যে চোখ হচ্ছে সবথেকে স্পর্শকাতর। তাই চোখে যখন কোনো ধূলিকণা পরে তখন মনে হয় এই বুঝি জীবনটা বেড়িয়ে গেল। সাথে সাথে আমরা ওই চোখে জলের ছিটে, ফুঁ, কিংবা রুমাল বার করে মুখের ভাপ নিয়ে লাগাতে শুরু করে দি। না জানি আরো কত কিছু করি সেই সময়। ক্ষণিকের জন্য হলেও, আমাদের প্রত্যেকেরই এই সময়টায় মনে হয় এই বুঝি অন্ধ হয়ে গেলাম। কি তাই তো?

প্রত্যেকের শরীরের গঠন অনুযায়ী তার চোখ ছোট বা বড় হয়ে থাকে। আমাদের শরীরে চোখ না থাকলে সব সৌন্দর্যই যেন মাটি হয়ে যায়। এই চোখের প্রকারভেদে তার নামকরণও হয় ভিন্ন ভিন্ন। আমরা বাংলা অথবা হিন্দি সিনেমার অনেক গানেই এই চোখের বর্ণনা পেয়ে এসেছি আর ভবিষ্যতেও হয়তো পাবো।

আমরা প্রত্যেকেই এই চোখকে নিয়ে খুব সচেতন থাকি। কারো কখনো একটু দৃষ্টিশক্তিতে অসুবিধা হলেই, আমরা সাথে সাথে দৌড়ই চোখের ডাক্তারের কাছে। তিনি ভালো করে পরীক্ষানিরীক্ষা করে, হয় তিনি ঔষধ লিখে দেন নয়তো লিখে দেন চোখের জন্য কোন  নির্দিষ্ট পাওয়ার। ব্যাস............, আমরাও তখন ছুটি চশমার দোকানে। তার পর নিজের পছন্দমত একটা ফ্রেম বেছে নিয়ে সেটাকে দিয়ে আসি পাওয়ার কাচ লাগানোর জন্য। এক দু দিন বাদে সেই চশমাটা এনে, সেটাকে পরে, তবেই শান্তি।

আগেকার মা ঠাকুমাদের দেখেছি তাঁরা অনেক বেশি বয়স পর্যন্ত খালি চোখেই কি সুন্দর দেখতে পেতেন। এমন কি ছুঁচেও সুতো পড়াতেন খালি চোখে। অথচ এখনকার সময়টাতে দেখুন, ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক , প্রত্যেকেরই চোখে চশমা। যাদের দৃষ্টিশক্তি একটু কম তাদের কাছে চশমার গুরুত্ব যে কি, তা শুধু তারাই জানে।যদিও ইদানিং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকেই নিত্যনতুন বাহারি চশমা পড়েন। তবে কারণ যাই-ই হোক না কেন, এই চশমা বর্তমানে মানুষের জীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। আচ্ছা, আপনারা কি জানেন, কে কবে এই চশমা আবিষ্কার করেছিল? আর কি ভাবেই বা তার ব্যবহার শুরু হয়েছিল?

চলুন তাহলে, আজ না হয়  আমরা এই চশমার সম্পর্কেই কিছু কথা জানি। আসলে এই চশমার ইতিহাস বহু প্রাচীন। মিশরীয় সভ্যতার মানুষেরা যে চশমার ব্যবহার করতো, তা আবিষ্কার করেছেন বিভিন্ন ইতিহাসবিদরা। সাধারণত কোনো জিনিসকে স্বচ্ছ ভাবে দেখার জন্য এই সময় বিভিন্ন কাচ ব্যবহারের প্রচলন ছিল।

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম দশকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতাকে দূর করার জন্য চোখে কাচের ব্যবহারের লিখিত প্রমাণ আছে। রোমান সম্রাট নিরোর একজন শিক্ষক ওই সময়ে দূরের জিনিস পরিস্কার করে দেখার জন্য জল মেশানো এক ধরনের কাচ চোখে লাগানোর কথা বলেছিলেন।

সত্যিকারের চশমা বলতে আমরা যা বুঝি তা কিন্তু দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের দিকে প্রথম প্রচলিত হয় ইতালিতে। ওই সময় আতশ কাচ লাগিয়ে ছোট জিনিসকে দৃষ্টিসীমায় নিয়ে আসার জন্য চশমার ব্যবহারের নজির আমরা ইতিহাসে পাই। ১২৮৬ সালের দিকে ইতালিতে জিওর্দানো দ্যা পিসা নামে এক ব্যক্তি প্রথমবারের মতো চশমা তৈরি করেছিলেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতাকে দূর করানো। রোমান গ্ল্যাডিয়েটরসদের লড়াই উপভোগ করতে গিয়ে নিজের আসনে বসে রোমান সম্রাট নিরো বিশেষ কাচ চোখে লাগাতেন এমন নজিরও আমরা ইতিহাসে পাই। এর কিছু দিন পর, ১৩০১ সালে ভেনিস সরকার চশমা বিক্রির জন্য কিছু নিয়মও ঠিক করে দিয়েছিল। অর্থাৎ ততদিনে  চশমার ব্যবসাও শুরু হয়ে যায়। সবচেয়ে পুরনো চশমার  একটি ছবি এঁকেছিলেন তোমাসো দ্য মোদেনা নামে এক ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী। আসলে তিনি একজন উচ্চপদস্থ লোকের পড়ার ছবি এঁকেছিলেন।আর সেই সময় লোকটি চশমা পরে ছিলেন। সুতরাং ১৩৫২ সালে আঁকা হয়ে যায় পৃথিবীর প্রথম চশমার ছবিটি। চশমা আবিষ্কার হয়ে গেলেও তা কি ভাবে কাজ করবে সেই ব্যাখ্যা তখনো মানুষ ঠিক করে বের করে উঠতে পারে নি। ১৬০৪ সালে অবশ্য সেই ব্যাখ্যা দেন জোহান্স কেপলার।

হয়তো আমরা প্রত্যেকেই জানি, যে বাইফোকাল চশমার বৈশিষ্ট্যই হল, একই চশমাতে দুটি আলাদা আলাদা পাওয়ার থাকা। চশমার এই বাইফোকাল জিনিসটি প্রথম উদ্ভাবন করেন আমেরিকার বিখ্যাত  বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন। পরবর্তী সময়ে জর্জ হোয়াটলে ও জন ফেনোকে ফ্র্যাঙ্কলিনের এই আবিষ্কারকে নিজেদের আবিষ্কার বলে দাবি করতে চেয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে তা ভুল প্রমাণিত হয়। এক গবেষণায় মনে করা হয় যে ফ্র্যাঙ্কলিন হয়তো অনেক আগেই এই বাইফোকাল চশমার উদ্ভাবন করেছিলেন।

একদম পুরোনো আমলের চশমার ফ্রেমগুলোকে দেখে এখন বেশ অদ্ভুত মনে হবে আপনাদের। আসলে ওই চশমা গুলোতে কোন ডান্ডা বা হাতল লাগানো থাকতো না। সেটাকে হয় হাত দিয়ে ধরে রাখতে হতো, আর না হলে নাকের উপর ঠেস দিয়ে রাখতে হতো। ইতালিতে ও স্পেনে ধীরে ধীরে এই চশমার ব্যবহার ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

জিওর্দানো দ্যা পিসার চশমার নকশার প্রায় চারশো বছর পর বদল আসে চশমার সাবেকি নকশায়। দুকানে জুড়ে যায় চশমার ফ্রেমের দুটি হাতল বা ডান্ডার মতো অংশ। ফলে হাতে ধরা চশমার থেকে অব্যাহতি পেয়ে তৈরি হয় আধুনিক চশমা। এই আধুনিক চশমার নকশাটি তৈরি করেছিলেন এক ব্রিটিশ চশমা বিক্রেতা ও বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুতকারক।যার নাম এডওয়ার্ড স্কারলেট। সম্ভবতঃ তিনিই প্রথম চশমার ফ্রেমে ডান্ডা ব্যবহার করে ছিলেন। যদিও সেই ফ্রেমের ডিজাইন তেমন ভালো ছিল না।পরবর্তী সময়ে অবশ্য এই ফ্রেমের ডিজাইনে ধীরে ধীরে অনেক উন্নতি হয়।

তবে আজ যে আধুনিক চশমা আপনারা দেখছেন এই আধুনিক চশমার আবিষ্কারক ছিলেন গিরোলামো সাভোনারোলা নামে আর এক ইতালিয়ান। তিনি ১৭২৭ সালে বর্তমান সময়ের চশমার প্রাথমিক নকশাটি তৈরি করেছিলেন। তাঁর সেই নকশাটিকে সামনে রেখেই এরপর ওই চশমার নকশা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। ধীরে ধীরে সেই পুরোনো নকশাই আস্তে আস্তে আধুনিকতার রূপ নেয়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours