জয়িতা ভট্টাচার্য, লেখক ও শিক্ষক, কলকাতা:

করোনা ভাইরাসের চেয়েও নিঃশব্দ সঞ্চারে ছড়িয়ে পড়ছে যে রোগটি, তা হলো মানসিক অবসাদ।

ক্রমাগত আর্থিক চাপ, মৃত্যু ভয় আর লাগাতার হোম আইশোলেশন বাড়িয়ে তুলেছে গার্হস্থ্য অশান্তি।

ফলাফল আত্মহত্যা। গত পাঁচ মাসে সরকারি হিসেব পাঁচশো ছাড়িয়েছে অর্থাৎ প্রকৃত সংখ্যাটা এর তিনগুণ। এই লকডাডাউন এর সময় শুধু ওড়িষ্যাতেই জানা যাচ্ছে মোট  জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে অবসাদগ্রস্ত হয়ে, কাজ হারিয়ে ও দারিদ্রে।

ভাবলে শিউরে উঠতে হয় যে মানুষটা কাজ হারিয়ে ফেলল, সমস্ত পরিবার তার রোজগারের ভরসায় বসে। সে কোনো উপায় করতে পারছে না, সে কাউকে বলতে পারছে না, দিনের পর দিন ধার আর দেনার পাহাড়।

ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যায় এমন কতো অভিমন্যু বক্তব্যের ভেতর। তাই একদিন আর কোনো পথ থাকে না মৃত্যুর হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া।

ভারতে কোরোনা প্যাণ্ডেমিকে যত মৃত্যু হয়েছে নিঃশব্দে আত্মহত্যা করেন তার কাছাকাছি মানুষ প্রতিবছর। দৃষ্টান্তস্বরূপ ২০১৩ তে ভারতে  ১,৩৪,৭৯৯ জন আত্মঘাতী হয়েছেন। এটি গড় সংখ্যা। 

কেন? কারন খুঁজতে গেলে উঠে আসে একটি তামসিক অনিশ্চয়তার ছবি, পরিকাঠামোহীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ছবি।

ভারতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে মূলত নিম্নলিখিত কারণগুলির জন্য__

অসুস্থতাজনিত অবসাদ 

পণপ্রথা 

নেশাগ্রন্থ ও সংকোচন উপসর্গ জনিত অবসাদ 

পরীক্ষায় অকৃতকার্য 

পারিবারিক সমস্যা 

প্রেম ঘটিত 

দারিদ্র্য 

বেকারত্ব

ঘনিষ্ঠ জনের মৃত্যু 

সামাজিক অপবাদ 

ও দেউলিয়া হয়ে বা ঋণজর্জরিত হয়ে।

উপরে উল্লিখিত কারণগুলির মধ্যে দেখা যায় ইদানিং দারিদ্র ও পণের জন্য অত্যাচারের আত্মহনন হ্রাস পেয়েছে।

কিন্তু নেশাসক্ত রোগী, সামাজিক বদনামের ভয় ও ঘনিষ্ঠ জনের মৃত্যুতে আত্মহত্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাকি কারণগুলির ক্ষেত্রে গড় সংখ্যা প্রায় অপরিবর্তিত।

মূলত একান্নবর্তী পরিবারের বিলুপ্তির, একাকীত্ব, সম্পর্কে জটিলতা ও বাজার অর্থনীতির আর্থিক চাপ বহু মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মহত্যার দিকে একথা অনস্বীকার্য।

ভারতে বিরাট সংখ্যক আত্মহত্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা কৃষক আত্মহত্যা এ কথাও অনেকের অজানা কারন প্রচার মাধ্যম আশ্চর্য নীরব এই বিষয়ে। 

এই প্রসঙ্গে আরেকটি অধ্যায় অবহেলিত।

মনে রাখা দরকার এখনো ভারতের গ্রামীণ জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর, ৮২ শতাংশের রোজগার কৃষি উৎপাদন নির্ভর।(২০১৭-১৮)। আমাদের দেশে এখনো কৃষক প্রথম শ্রেণীর নাগরিক নয়, "সোনার ফসল ফলায় যে তার দুই বেলা জোটে না আহার"।

মহারাষ্ট্রের মারাঠাওয়াড়া গ্রামে ১ জানুয়ারি ২০১৯-২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ এই দুই মাসে ৩৯৬ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছে খরা ও দেনার দায়ে। প্রতি বছর বছরের প্রথম ছয় মাসে সেখানে গড় আত্মহত্যা করেন ৩০০ থেকে ৪০০ জন কৃষক শুধু এই গ্রামে।  ভারতে সংখ্যাটা হাজার। যদিও এটা সরকারি হিসেব, ধরে নেওয়া যেতে পারে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যাটি এর দ্বিগুণ।

ফসল নষ্ট, খরা, ঋণ তো আছেই এছাড়া  চিট ফাণ্ডের জালে পড়ে ১৫.০৪ দশমিক কৃষক আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।

সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করতে হয়েছে ঔরাঙ্গাবাদ সাবডিভিসান ব্লকের জালনা, পারভনি, বীড, ওসামাবাদ, নানদেড়, লাটুর, হিংগোলি।

প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা ও রাষ্ট্রীয় কৃষি যোজনার টাকা নামমাত্রই ব্যয় হয়েছে কৃষক কল্যাণ খাতে ১৯৯৯ থেকে ২০১৫ অবধি।

আশার কথা এর পরের বছরগুলিতে কৃষকদের জন্য বরাদ্দ টাকা কিছুটা ঠিকঠাক ব্যবহার হচ্ছে। 

সরাসরি বিক্রি, বীমা ও ভালো মৌসুমি বৃষ্টি পাতের জন্য ২০২০ তে সংখ্যাটা হ্রাসমান।

নাগরিক জীবনে আত্মহত্যা অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার কারনে ঘটে, উপরের কারণগুলি ছাড়াও।

আত্মহননের প্রবণতা  বিশেষত সৃজনশীল মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায় দেশ কাল সমাজ নির্বিশেষে। তাঁরা সংবেদনশীল হন। আর যত গভীরে যাওয়া যায় জীবনের ক্লিশে যাপনের সামনে মৃত্যু এক দিগন্ত হয়ে দেখা দেয়।অনাবিষ্কৃত এক রহস্য।

এব্যাপারে অনেক মনস্তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন, থিয়োরি দিয়েছেন কিন্তু  শেষ পর্যন্ত  ওই "বিপন্ন বিস্ময় যা আমাদের হাতছানি দেয় এক অদেখা দিগন্ত রেখার দিকে।

মৃত্যু সম্পর্কে তাই রহস্য ঘনীভূত হয়। জন্মান্তরবাদ, প্ল্যানচেট, নানা কিছু প্রভৃতি চলতেই থাকে মৃত্যু ঘিরে।

বাঙালি ভাষায় বোধহয় সবচেয়ে জনপ্রিয় বইটি লিখেছেন স্বামী অভেদানন্দ "মরণের পারে"। তাঁর বইটির দ্বারা প্রভাবিত স্বামী বিবেকানন্দর বইটি।

এই বইটি যতটা সম্ভব ভাবে লিখেছেন তিনি নিজস্ব উপলব্ধি জারিত করে, যদিও বইটি বিজ্ঞানসম্মত।

মৃত্যুর একটা অমোঘ আকর্ষণ আছেই।

তাই অনেক সময়ই দেখা যায় আত্মহত্যার সঠিক কোনো কারন তদন্ত করে পাওয়া যায় না অথবা পরিবার বা নিকটজনেরাও ভেবে পান না হাসিখুশি, দৃঢ় চরিত্রের সুখী মানুষটি হঠাৎ করে কেন আত্মহত্যা করে বসল।

মানসিক অবসাদ হলে মনস্তাত্ত্ববিদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

মানসিক দৃঢ়তা সর্বোপরি নিজেকে ভালোবাসা একটি সমাধান অবশ্যই।

ধ্যান একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অথবা সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা।

যদিও এটি লক্ষ্যণীয় যে বিশ্বে সৃজনশীল ব্যক্তির মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। 

অনেকের কাছেই জীবন একঘেয়ে হয়ে যায়। একটা সময়ের পর আর কোনো অভিনবত্ব থাকে না। একঘেয়ে সুখ বা একঘেয়ে দুঃখ কোনোটাই বরদাস্ত হয় না। জীবন ক্লান্ত করে।

"যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ 

মরিবার হলো তার সাধ"

আরো এক বিপণ্ণ বিস্ময় 

আমাদের অন্তর্গত  রক্তের ভেতর খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে

ক্লান্ত ক্লান্ত করে 

লাশকাটা ঘরে 

সেই ক্লান্তি নাই,

তাই

লাশকাটা ঘরে 

চিৎ হ'য়ে শুয়ে আছে টেবিলের' পরে।"


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

2 comments so far,Add yours

  1. Nice informative article Jayeeta. Thanks for highlighting the mental diseas wwhich is not easily visible.

    ReplyDelete
  2. Nice informative article Jayeeta. Thanks for highlighting the mental diseas wwhich is not easily visible.

    ReplyDelete