রমা চক্রবর্তী, শিক্ষিকা, আবৃত্তিকার ও ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

আজ ১৬ ই আগষ্ট ২০২০ সাল, গতকাল অর্থাৎ ১৫ ই আগষ্ট আমরা ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবস পালন করলাম| সারা বিশ্বব্যাপী করোনা আবহেও যে যতটুকু সামর্থ্য আমরা ১৫ ই আগষ্ট পালন করেছি| সবাই নিজের মত করে চেষ্টা করেছি বীর শহীদদের স্মরণ করতে| এইভাবে এক-একটি দিন পার করে আমরা স্বাধীনতা ৭৫ এ পৌঁছে যাব|

তবে জানি না আমরা কি সত্যিই শহীদদের স্মরণ করতে পারি কিনা বা সম্মান করতে পারি কিনা| যাদের রক্ত, ঘাম এর বিনিময়ে এই স্বাধীনতা তাঁরা আজ বেঁচে থাকলে কী বলতেন?

এরকমই একজন মানুষের কথা বলি---আমার দাদামশাই প্রয়াত সুধীর কুমার চক্রবর্তী একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন| ২০১০ সালে ২ রা মার্চ তাঁর মৃত্যু কালে বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর| তাঁর স্মৃতিচারণে যেটুকু জানতে পেরেছি তাঁর জন্ম অধুনা বাংলাদেশের যশোর জেলার তালতলা, ন-পাড়ায়| তিনি যখন কৈশোরে তখন উত্তপ্ত দেশভাগ আন্দোলন, নেতাজীর অনুপ্ররণায় অনুপ্রাণিত ছিলেন আমার দাদামশাই|

নেতাজী যখন কলকাতা কর্পোরেশন এর মেয়র পদে তখন দাদামশাই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন| তাঁর দেওয়া উত্তোরীয়টি দাদামশাই স্বযত্নে রেখে দিয়েছিলেন| এবং ঐ সময় তিনি দু- বার আন্দোলনের সদস্য হিসাবে কারাবরণ ও করেছিলেন| নেতাজীর অন্তর্ধানের পর থেকে দাদামশাই ঐ উত্তোরীয়টিকে দেবতা স্থানে বসিয়ে পূজো করতেন|

এরপর পরিবারের সাথে এপারে এসে ইছামতী নদী পার্শ্ববর্তী এলাকা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার নহাটা গ্রামে চলে আসেন| তিনি সংস্কৃতি নাটক, যাত্রা, সংগীত এসবের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাপ মানুষের মধ্যে জাগাবার চেষ্টা করে গেছেন। এবং একটা সময়ের পর তিনি আধ্যাত্মিকতার জগতে চলে যান ঋষি অরবিন্দের অনুপ্রেরণায়|

এরপর আসে ভারতবাসীর বহু আকাঙ্খিত ১৫ ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবস| ঐ দিনটিতে আমার দাদামশাই ভারত মাতার পূজো করতেন, বাড়ীতে পতাকা উত্তোলন করতেন এমনকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে যেতেন|পরবর্তী কালে তাঁর উদ্যোগে নহাটা কলেজ, গ্রন্থাগার, বালিকা বিদ্যালয় এগুলি প্রতিষ্ঠা হয় |

 কিন্তু ১৫ ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করলেও তিনি ২১ শে অক্টোবর যেদিন সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৪৩ সালে মনিপুরে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন সেই দিনটিকেই দাদামশাই পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবস পালন করতেন| সবাই তাঁকে ওখানকার ভূমিপুত্র বলেই জানত| 

তিনি জীবনে কোনোদিন সরকারী অনুদান, সরকারী পেনশন, টেলিফোন গ্রহন করেননি|

মৃত্যু কাল পর্যন্ত একটাই দুঃখ ছিল তাঁর। জড়ানো স্বরে ও ভেজা ভেজা চোখে আক্ষেপ করে হামেশাই বলতেন, "এই তিন টুকরো স্বাধীনতা আমরা চাইনি, আমরা চেয়েছিলাম অখন্ড ভারতবর্ষ যা নেতাজীই একমাত্র পারতেন, তিনিই এই পথ দেখিয়েছিলেন|" 

শুধু আমার দাদামশাই নন বহু গ্রামে-গঞ্জে এমন মানুষ এখনও হয়তো বেঁচে আছেন যারা এই স্বাধীনতা চাননি| বর্তমানের নেতাদের নেতা হিসাবে মানতে ঘৃণা বোধ করেন| কারণ তাঁরা দেখেছেন নেতা কাকে বলে? তাঁরা তাদের নেতাদের অনুপ্ররণায় দেশের জন্য আত্মবলিদান দিয়েছেন|

আমি খুব গর্বের সাথে বলতে পারি যে আমার দাদামশাই এর অনুপ্রেরণায় আমাদের আত্মীয় পরিবার বর্গের ১৫-২০ জন আছেন দেশ সেবায় নিয়োজিত কেউ Army, কেউ CRPF, কেউ Navy তাদের মধ্যে কেউ Retired আবার কেউ দেশ সেবায় নিয়োজিত বর্তমানে|

অর্থাৎ অন্তর থেকে দেশভক্তি না থাকলে স্বাধীনতা মূল্যহীন| যাদের ঘরে এরকম সৈনিক আছে তারাই জানে দেশসেবা কাকে বলে? এর জন্য কতটা মনের জোর দরকার|


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours