ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির সর্বকালের মহানায়ক। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর সংগ্রামের ফসল আজকে বাংলাদেশ। 

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ থানার টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম গ্রহন করেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা মোসাম্মৎ সায়রা খাতুন। সহধর্মিনী ফজিলাতুননেসা। দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তিন ছেলে শেখ জামাল, শেখ কামাল ও শেখ রাসেল।

জন্মের ১৩টি বছর বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়ায় কাটিয়েছেন। সে সময় বাবা দেওয়ানি আদালতে সেরেস্তাদার ছিলেন। টুঙ্গিপাড়ার গিমাভাঙ্গা স্কুলে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়ে ১৯৩৬ সালে বাবার কর্মস্থল মাদারীপুর ইসলামিয়া স্কুলে ক্লাস ফোর এ ভর্তি হন। সে সময় বঙ্গবন্ধু ভেরিভেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে চোখে ছানি পড়ে। বাবা বদলী হয়ে গোপালগঞ্জ এলে বাবার সঙ্গে সেখানে এসে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হন। কিছুদিন পর চোখের সমস্যার কারণে লেখাপড়া বন্ধ হয়। ডাক্তারের পরামর্শমতে চশমা ব্যবহার শুরু করে। লেখাপড়া সাময়িক বন্ধ ছিল। চোখ ভাল হওয়ার পর ১৯৩৭ সালে আবার গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুলে ভর্তি হন। সে সময় মুসলমান ছেলেদের ক্লাসের সামনের বেঞ্চে বসার সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জেদি। হেড মাষ্টার স্নেহ করতেন। ছেলেরা মুজিব ভাই বলে ডাকত। কারন কেউ কিছু বলার সাহস পেত না।

১৯৩৮ সালে হাইস্কুলে পড়ার সময় বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ.কে. ফজলুল হক, বাণিজ্য ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী শহীদ সরোয়ার্দী দুই জনে গোপালগঞ্জে আছেন। তাঁরা কংগ্রেস বিরোধী মন্ত্রী। তাদের আগমনে কৃষক পার্টি আর মুসলিম লীগ তাদের সংবর্ধনার আয়োজন করে। তখন কংগ্রেসের কিছু লোক মন্ত্রীদের আগমনে বাঁধা সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের নিয়ে সে বাঁধা উপেক্ষা করে সংবর্ধনার পক্ষে কাজ করেন। বাঁধা উপেক্ষা করে সংবর্ধনা হয়। সংবর্ধনা শেষে মন্ত্রীদ্বয় ফিরে যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু পথ আগলে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের ছাত্রাবাস সংস্কারের দাবী জানায়। মন্ত্রী তখন  ছাত্রাবাসের জন্য ১২০০ টাকা দেন। বঙ্গবন্ধুর সাহস দেখে সরোয়ার্দীর নজর কাড়েন। তারপর থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। এক সময় ঘনিষ্ট হন। তিনিই হন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দীক্ষাগুরু।

সে সময় মুসলমানরা ছিল নিগৃহীত। মুসলমান মন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়ায় কংগ্রেস গোড়া হিন্দুরা সংঘর্ষ বাধায়। বঙ্গবন্ধু সে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সে দাঙ্গায় থাকায় বঙ্গবন্ধুর জেল হয়। জীবনের প্রথম কারাবাস। বাবার সুবাদে ৭দিনে জেল থেকে ছাড়া পায়। অনেকেই তখন থেকে বঙ্গবন্ধুকে নেতা ভাবতে শুরু করে।

১৯৪০ সনে বঙ্গবন্ধু ক্লাস নাইন এর ছাত্র। স্কুলের মাঠে ছাত্রদের সভা হবে। গোপালগঞ্জের একজন নেতা এসডিওকে দিয়ে সভা বন্ধ করান। ছাত্ররা বাধ্য হয়ে মসজিদের কাছে সভা করে। সে সভায় বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভাষন দেন। সে ভাষনের কারণে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ছাত্রদের দাবীর মুখে সহসাই তিনি মুক্তি পান। 

১৯৪২ সালে প্রবেশিকা পাস করে কলকাতা ইসলামি কলেজে ভর্তি হন। ইসলামিয়া কলেজ ছিল মুসলিম রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র। বঙ্গবন্ধু থাকতেন বেকার হোস্টেলে। সেখানেই কেটেছে কলেজ জীবন। কলেজকেই ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে মুসলিম ছাত্রদের রাজনীতি। সে সময় মুসলমানদের দল ছিল একটি। সেটি হলো মুসলিম লীগ। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের সভাপতি। এ.কে. ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী। শহীদ  সোহরোওয়ার্দী বাংলার মন্ত্রী। ফজলুল হকে জিন্নাহ সাহেবের বিরোধ তখন চরম। হক সাহেবকে জিন্নাহ সাহেব মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কার করেন। হক সাহেব তখন শরৎ বসুর ফরোয়ার্ড ব্লক হিন্দু মহাসভার শ্যামা প্রসাদ আর তহশিলীদের সাথে নিয়ে নতুন মন্ত্রী সভা গঠন করেন। মুসলিম লীগকে মন্ত্রী সভার বিরুদ্ধে সেই সঙ্গে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এই সংগ্রামে অংশগ্রহন করে মুসলিম লীগে ফিরে যান। তখন সোহরোওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ট হন। মুসলিম লীগের বিরোধিতা করে আর মুসলমানদের অপপ্রচারের কারণে ১৯৪২ সালে ফজলুল হক মুসলিম লীগ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

কট্টরপন্থী হিন্দুরা বঙ্গবন্ধুকে মুসলিম লীগ থেকে সরে আসার জন্য প্রলোভন দেখায়। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা ভেবে তাদের প্রলোভনে সাড়া দেননি। তখন ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি আইনের ছাত্র। থাকতেন কারমাইকেল হোস্টেলে। তখন দুই ছাত্র নেতা। বঙ্গবন্ধুর সাহসই তার কাজের প্রেরণা।

১৯৪২ সালে মহাত্মাগান্ধী ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু করেন। একদিকে ফজলুল হক মুসলিম বিরোধী হন ইংরেজ গর্ভনর হাভার্ট হক সাহেব থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাংলার প্রধানমন্ত্রী করেন। ঐ মন্ত্রী সভায় সোহরোওয়ার্দী খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তার আগেই সরকার চাল চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। ফলে বাংলায় খাদ্যভাব দেখা দেয়। শুরু হয় বাংলায় দুর্ভিক্ষ। বঙ্গবন্ধু সোহরোওয়ার্দীর সঙ্গে জন সেবায় নামেন। বঙ্গবন্ধু তখন টাঙ্গাইলে দানবীর আরপি সাহার সঙ্গে পরিচিত হন। বঙ্গবন্ধু নিজের গোলার ধান দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে খাদ্য বিলিয়ে দেন। গোপালগঞ্জে কোর্ট কমিটি করে ধান সংগ্রহ করে গরীবদের মধ্যে দেয়। এতকিছুর পরেও বাংলা ১৩৫০ সনের দুর্ভিক্ষে ৫০ লক্ষ লোক মারা যায়। সে কারণে ঐ দুর্ভিক্ষকে ৫০ এর মন্বন্তর নামে পরিচিত। 

বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষের সময় প্রায় ৫০ জন ছাত্র নিয়ে একটি মিছিল বের করেন। মিছিলটি খাজা নাজিমুদ্দিন এর বাস ভবনে যায়। সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কিছু কথা বলেন কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন সেটা পছন্দ করেননি। দাবী পূরনের কোন আশ্বাসও দেননি। বাংলার সে দুর্ভিক্ষকালের সাক্ষী হয়ে আছে।

পরের বছর বগুড়াতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্স ফেডারেসনের একটি সম্মেলন ডাকা হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৪০ জন ছাত্র সে সম্মেলনে যোগদান করেন। সেই সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উত্থান। বঙ্গবন্ধু ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন। তার বক্তৃতা শুনে সভাস্থলে সবাই মুগ্ধ হতেন। 

১৯৪৪ সালে ১৭ নভেম্বর বঙ্গীয় মুসলিম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সম্পাদক নিয়োগে সমস্যা দেখা দেয়। বিভিন্ন নেতারা বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধু আবুল হাসিমকে সম্পাদক করার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বক্তৃতা দিলে সবাই আবুল হাসিমকে সম্পাদক করেন। তা দেখে সোহরোওয়ার্দী সাহেব খুশি হন। বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে সোহরোওয়ার্দী সাহেব ফরিদপুরে নির্বাচনে অংশ নিলে বঙ্গবন্ধু তার পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালান। গ্রামের পর গ্রাম তিনি প্রচার চালিয়েছেন। ফরিদপুরের খুব কম গ্রামই আছে যেখানে তাঁর পা পড়েনি।

১৯৪৬ সালে বিএ পরীক্ষার দেওয়ার কথা ছিল। রাজনীতির ঝামেলার কারণে দিতে পারেননি। পরের বছর ১৯৪৭ সালে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে বিএ পাস করেন।

ব্যক্তিজীবনঃ বঙ্গবন্ধু ১৯ বছর বয়সে তার চাচাতো বোন ০৯ বছর বয়সী ফজিলাতুননেসার সঙ্গে বিয়ে হয়। ১৯৪৭ সালে বিএ পরীক্ষার পর সে বছর ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার জন্ম হয়। পরীক্ষার কারণে তাকে জন্মের পর পর দেখতে পারেননি। কারণ কলকাতা থেকে টুঙ্গিপাড়া আসতে অনেক সময় লাগত।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হলে দুই বাংলা এক রেখে বঙ্গবন্ধু আন্দোলন করেন কিন্তু কট্টরপন্থী মুসলমানদের কারণে তা হয়ে ওঠেনি। পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান দুই প্রদেশ আলাদা রাষ্ট্রে পরিনিত হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। পাকিস্তান স্বাধীনের পর মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দুর প্রস্তাব করেন। এ খবর প্রচারিত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার ছাত্র বুদ্ধিজীবী মহল ২৬ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ধর্মঘট পালন করেন। এই ধর্মঘটের মিছিল আয়োজনে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই হরতালে বঙ্গবন্ধু মিছিল নিয়ে সরাসরি সচিবালয়ে যান। হরতালের সময় তিনি বক্তৃতা দেন। পুলিশ লাঠিচার্জ করে ৩০০ ছাত্রকে গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধু তাদের অন্যতম। ১৫ মার্চ জেল থেকে ছাড়া পান।

১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ১৯ তারিখ বিকালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার বোন ফাতেমা জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ জনসভায় ভাষন দেন। এই ভাষনে পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা উর্দু ঘোষণা করলে সাথে সাথে সবাই নানা বলে চিৎকার করে। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনসহ অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরে ২৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষন দেন। সেখানেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার কথা উল্লেখ করেন। ২৮ মার্চ জিন্নাহ ৩য় ও শেষ ভাষন দেন। সেখানেও একই কথা বলেন। শুরু হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লড়াই। ১৯৪৯ সালে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা ধর্মঘট করে। তাদের সমর্থনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ ৫ মার্চ থেকে ধর্মঘট শুরু করে। ফলে কর্তৃপক্ষ ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। ১৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবীতে ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯ এপ্রিল অবস্থান ধর্মঘট পালিত হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। 

১৯৪৮ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি সংগঠনের গোরাপত্তন হয়। ১৯৫০ সালে মুসলিম লীগ বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়। এভাবেই আওয়ামী লীগের জন্ম। আওয়ামী লীগের মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী। পাকিস্তানী দুটি দল হয়। প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগ। ভাষা সংগ্রামে অংশ গ্রহন করার কারণে বঙ্গবন্ধুকে বহিস্কার করেন। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু অংশ গ্রহন শুরু করেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ দুই বছর দুই মাস জেলে থাকেন। তার জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা মর্যাদা পায়।

১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ  সারা দেশে জাতীয় পর্যায়ে নিবার্চন অনুষ্ঠিত হয়। ২ এপ্রিল সরকারীভাবে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। যুক্তফ্রন্ট পায় ২২১টি আসন, মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন। মুসলিম লীগের এই ভরাডুবি বাঙালির জয় তথা বাংলা ভাষার জয়।

১৯৫৪ সালে ৩ এপ্রিল যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়। এ.কে. ফজলুল হক পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। এই মন্ত্রী সভায় বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব পান শিল্পমন্ত্রীর। মাত্র ৫৭ দিন মন্ত্রীসভা চলার পর দেশদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নবাদীতার অভিযোগ এনে মন্ত্রীসভা বাতিল করে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর নির্বাচন করা হয়। একই বছর পাকিস্তানের গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। 

১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ সদস্যের মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়। তার মধ্যে জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী একই সাথে পাকিস্তান আর্মির কমান্ডার ইন চীফ করা হয়। তারপর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নানা মুখী ঘটনা চলার পর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ৪ জন জেনারেলকে অস্ত্রে মুখে ইস্কান্দার মির্জাকে পদ ত্যাগ করতে বাধ্য করে ২৮ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সেই সঙ্গে সিএমএলএ ঘোষনা করেন আইয়ুব খান। শুরু হয় ধরপাকর বন্ধ  হয় রাজনীতি। 

১৯৬২ সালে ২৭ এপ্রিল এ.কে. ফজলুল হক মৃত্যু করেন। তখন বঙ্গবন্ধু জেলে। ১৯৬২ সালের ৮ জুন আইয়ুব খান সামরিক আইন প্রত্যাহার করে। বঙ্গবন্ধু তখন ছাড়া পান। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ৮ জুলাই পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভা হয়। সে সভায় বঙ্গবন্ধু ভাষন দেন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী ইতিহাস। ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা, সোহরোওয়ার্দীর মৃত্যু নানা ঘাত প্রতিঘাত। অবশেষে আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে সাধারন নির্বাচন দেয়। সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করে। ১৯৭১ সালে ৩ জানুয়ারী আওয়ামী লীগের পক্ষ রেসকোর্স ময়দানে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের আড়ম্বরপূর্ণ শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শপথ শেষে বঙ্গবন্ধু ৫০ মিনিট ভাষন দেন। ৭ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য মোস্তফা কবিরকে সৌভাগ্যক্রমে আগেই সে ছোরাসহ ধরা পড়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য ভুট্টো ও ইয়াহিয়া চক্রান্ত করতে থাকে। শুরু হয় অসযোগ আন্দোলন। চলতে থাকে মিছিল মিটিং। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেন। সে ভাষনই বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষন যা আজও সেরা ভাষন বলে চিহ্নিত। তাঁর বজ্রকণ্ঠ দেশ বিদেশে আলোচিত হতে থাকে। ইয়াহিয়া খান কালক্ষেপন করতে থাকে। পরিশেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হানাদার পাক বাহিনী ভারী অস্ত্রসহ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করে স্বাধীন বাংলা বেতারে সে ঘোষনা পাঠ করা হয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।  স্বাধীনতা পরবর্তী চার বছর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দ্বায়িত্বপালন করেন। তিনি বাংলাদেশটাকে এক অনন্য রূপ দিতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বিশ্বের বুকে অবহেলিত বাঙ্গালীকে এত উচ্চশিখরে নিয়ে যেতে। কিন্তু কিছু ক্ষমতালোভী নরপিশাচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অতর্কিত হামলা করে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বসবাসরত বঙ্গবন্ধু তথা পরিবারের সকলকে নিহত করেন। বাঙালী হিসাবে এ এক লজ্জাকর দিন। যেখানেই তিনি থাকেন না কেন, আত্মার শান্তি কামনা করি।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours