সুস্মিতা পাল, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কলকাতা:
১: বছরখানেক পরে স্কুল কলেজ খুলেছে। আবার সকাল সকাল ঘুমভাঙ্গা চোখে ব্যস্তহাতে কাজ সারা, স্কুলবাসের জন্য তিতিরকে তৈরী করা, দমফেলার ফুরসত নেই। সিদ্ধার্থ আর মৌমিতা ভেবেছিল বাবাকে বলবে মর্নিং ওয়াকের সঙ্গে বাজারটা আবার শুরু করতে। চিরকাল বাবার দৌলতে টাটকা মাছ সবজি খাওয়ার অভ্যাস। করোনার দাপটে অনেকদিন তো চললো অনলাইনে কেনাবেচা। যতই হোক, ফ্রোজেন জিনিসের স্বাদ একটু হলেও আলাদা। টেস্টবাডগুলোয় মরচে পড়ে গেছে যেন। বাবা কোনোদিন বাজার করার জন্য টাকা নেন না, এই বাজারে সেটাও কম কথা নাকি! ফোনে বুকিং করলে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকেই পেমেন্ট করতে হয়, পকেট ফাঁকা হয় খানিক।
বলি বলি করে আজ বলেই ফেলল মৌমিতা, ''বাবা, ব্যাগটা নিয়ে যান, ফেরার সময় এবার থেকে আগের মতো বাজারটা ঘুরে আসবেন। আর তো কোনো ভয় নেই। ''জুতোয় পা গলিয়ে ফিরে তাকালেন অনীশবাবু, ''এই মহামারী অনেক কিছু শেখালো মা। সংসারে কেউ আসলে কারো নয়। আর কিছুতে জড়াবো না শেষ বয়সে। বেশ তো ঘরে বসে বাজার হচ্ছিল, ওটাই চলুক। '' গুনগুন সুর ভাঁজতে ভাঁজতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে থাকলেন অনীশবাবু।
২: আর মিনিট দুই বাকি, ধৈর্য রাখতে পারছে না রাতুল। আট মাস তিলে তিলে স্বপ্নের যে চারা বুনেছে, আজ তাতে ফুল ফোটার পালা। বছর ঘুরতে চলল, ঘরে বসে অফিস করতে করতে একঘেয়েমি গিলে খেতে আসতো, শুধু সুনয়নার চোখদুটো ছিল ঐ দমবন্ধ জীবনে এক ঝলক তাজা বাতাস। আই. টি. র ঝকঝকে পরিবেশ, মিটিং, স্যালারি হাইক, সহকর্মী নন্দিতার মডেলসুলভ চলন বলন দিনের পর দিন দর্শন করতে করতে প্রায় প্রেমে পড়ো পড়ো অবস্থা এবং বেশ কয়েকবার একসঙ্গে কফি, সিনেপ্লেক্সে ঢুঁ মারার পরে প্রোপোজ করবে করবে, ঠিক তখনই পৃথিবী জুড়ে করোনা উৎসব।সে এক দিন গেছে বটে। ঐ সময়েই ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোখ আটকেছিল দুটি চোখে। সুনয়না নামের প্রোফাইলটা নতুন খোলা বা খুব একটা ব্যবহার হয় না বোঝা গেছিল মাত্র দু চারটে পোস্ট দেখে, তাও ব্যক্তিগত কোনো ছবি বা লেখা নয়। রাতুল শুধু দেখছিল প্রোফাইলে মাস্ক পরা মেয়েটির দুটি চোখ। পাখির নীড়ের মতো হয়তো এমন চোখকেই বলে। কি এক মায়ার টানে জড়িয়ে ঐ চোখে আশ্রয় খুঁজছিল রাতুলের উদভ্রান্ত মন। রাতের পর রাত জেগে মেসেঞ্জারে শুধু কথারা বয়ে গেছে, কখনো সবুজ আলো জ্বলা নীরবতা বাঙ্ময় হয়েছে। কদিন আগে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীকে বিপন্মুক্ত ঘোষণা করার পরে আজ CCD র সামনে দেখা করতে চেয়েছে রাতুল সুনয়নার সঙ্গে। একসঙ্গে আগামী জীবন পথচলার ইচ্ছা আজ স্পষ্টভাবে জানাবে। যদিও গোপন কথাটি গোপন নেই এই কয়মাসের ঘনিষ্ঠ ভার্চুয়াল আলাপে, মন চিনে নিয়েছে মনের মানুষকে।
একটু পরে রাতুল দেখতে পেল তার কথামতো মভ কুর্তি পরা যে মেয়েটি CCDর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সম্পূর্ণ মুখ আগে অদেখা হলেও কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়া চুল আর কথামতো হাতে ধরা লাল ফোনে সে নির্ভুল সুনয়না। ফোনে মেসেঞ্জারে সবুজ আলো জ্বলে উঠল -' আয়াম ওয়েটিং। হোয়ার আর য়ু? ' রাতুলের মনের ঘরে একটা একটা করে আলো নিভছিল। এই সাধারণ মেয়েটিকে তো সে চেনে না। সম্পূর্ণ সুনয়নার মধ্যে তার চোখদুটো আলাদা করে আর টানল না রাতুলকে। অসাড় মনে অনিচ্ছুক পা দুটো গাড়ির দিকে ফেরাল রাতুল। সামনের সিগন্যাল লাল থেকে সবুজ হওয়ার অপেক্ষা। তাড়াতাড়ি পালাতে চাইছিল রাতুল। খানিক পরে বাইপাসের ফাঁকা রাস্তায় স্পিড বাড়াতে বাড়াতে রাতুল ভাবছিল,'' কি যে বোকার মতো ভুল করতে যাচ্ছিলাম। কাল অফিসে গিয়ে নন্দিতাকে একবার বলে দেখতে হবে weekend এ একসঙ্গে বেরনো যায় কিনা! ''
সেদিন সদ্য সেরে ওঠা শহর জুড়ে নেমে আসা সন্ধ্যা নাকি সুনয়নার চোখের বিষণ্ণ অপেক্ষা - কে যে বেশী গভীর ছিল, বলা কঠিন।
৩: পার্টি অফিসে চূড়ান্ত ব্যস্ততা, দলনেতা আজ সদস্যদের সঙ্গে মুখোমুখি মিটিং করবেন। বছরভর যেন কালরাত্রি চলছিল। সামনাসামনি দেখা হয়নি কমরেডদের সঙ্গে। টেলিকনফারেন্স, অনলাইন মিটিং, ফোনে নির্দেশ এভাবেই চলেছে।আলাদা করে কারো কারো দেখাসাক্ষাত হয়েছে তবে তার সঙ্গে কি এই মহামেলার তুলনা চলে! সবাই ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজনা বোধ করছেন। কয়েকজন সদস্যকে চিরদিনের জন্য কেড়েও নিয়েছে মহামারী। তাই শুরুতেই দু মিনিটের নীরবতা পালন করা হল তাদের স্মৃতির উদ্দেশে।
শেষমেশ শুরু হল বহু প্রতীক্ষিত সভা। চেয়ারে গুছিয়ে বসে দলনেতা প্রথমেই উপস্থিত বাকি সকলের উদ্দেশে বলে উঠলেন -'' গুড আফটারনুন এভরিবডি। প্লিজ, মিউট ইওরসেলভস্ বিফোর দ্য মিটিং স্টার্টস্। ''
Post A Comment:
0 comments so far,add yours