সুকন্যা পাল, ম্যানেজিং এডিটর, দ্য অফনিউজ, কলকাতা:

মাত্র ৩৬ বছর বয়স। পেশাগত সাফল্যের গ্রাফটা ছিল যথেষ্ট নজরকাড়া। কিন্তু হায় বিধাতা! স্তব্ধ হয়ে গেল আচমকা বুকের ধুকপুক তাজা হৃদপিন্ডটি। গিয়েছিলেন হাসপাতালে। যাবার আগে ফুটফুটে নয় বছরের আত্মজাকে বলে গিয়েছিলেন, আমি ঠিক ফিরে আসবো দেখিস। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই 'কেউ কথা রাখে না' আবার একবার আংশিক সত্য প্রমাণিত করে তিনি যে আর ঠিকই ফিরলেন না। আসলে আংশিক এজন্যই, ফিরেছিলেন বাস্তব। সবুজ প্রাণময় হয়ে নয়। সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত হয়ে। বাস্তবিকই তিনি ছিলেন শিক্ষাসাধক। তাই কথা রাখবেন না এমনটা কিন্তু হবার কথা ছিল না। আক্ষরিক অর্থে তাঁকে যে অবচেতন করে শল্য চিকিৎসার শয্যায় কথা রাখতে দেওয়া হল না। তাই বাঁধ ভাঙা কান্নায় ক্ষাণিক দিশেহারা হয়ে সদ্য সিঁদুর মোছা তাঁর স্ত্রী বলে উঠলেন, স্রেফ ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে আমার স্বামী ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন।
সেকি কেন? কিসের ভুল চিকিৎসা? কিভাবেই বা এই মর্মান্তিক জীবন স্তব্ধতা ঘটে গেল? এসব জানতে হলে পিছিয়ে আসতে হবে ১০ জুলাইয়ের বিকেলের অভিমুখে। বেশ কিছু দিন ধরেই গলব্লাডারে স্টোন সমস্যায় কষ্ট পাচ্ছিলেন ৩৬ বছরের কেমিস্ট্রির সহকারি অধ্যাপক পরীক্ষিত মন্ডল। তিনি দুর্গাপুর ওমেনস কলেজে অধ্যাপনা করেন। স্থায়ী বাড়ি বোলপুরে। ওই দিন বিকেলে বর্ধমান ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর সংশ্লিষ্ট রোগের কারণে অপারেশন করা হয়েছিল। বর্ধমানের এই হাসপাতালে চিকিৎসক শুভ্রাংশু চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে এই অপারেশন সম্পন্ন হয়। এমনকি অপারেশনের ঠিক পূর্ব মূহুর্তে রোগীর শারীরিক অবস্থা যথেষ্ঠ অপারেশন করার উপযোগী ছিল বলেও পরীক্ষিতবাবুর পরিবারবর্গকে জানানো হয়েছিল ওই হাসপাতালের তরফে। অথচ গলব্লাডারে স্টোন অপারেশন সম্পন্ন হবার পর পরীক্ষিতবাবুর শারীরিক অবস্থা দেখে উপস্থিত পরিজনদের মনে অজানা এক ভীতি সন্দেহের দানা বাঁধে। তাঁদের অস্থিরতা দেখে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক জানান, রোগীর কার্ডিয়াক প্রবলেমে আচ্ছন্ন। আর এখান থেকেই শুরু হয় এহেন সামান্য অপারেশন নিয়েই বিতর্ক। পরীক্ষিতবাবুর স্ত্রী মৌমিতা বিশ্বাসের অভিযোগ, শুভ্রাংশুবাবু নিজে জানালেন অপারেশন শেষে রোগীর কার্ডিয়াক প্রবলেম হয়েছে। কিন্তু অবচেতন স্বামীকে রাত একটা পর্যন্ত নিজেদের তত্ত্বাবধানে রাখলেন কোনওরকম হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা ছাড়াই।
মৌমিতাদেবীর অভিযোগ এখানেই শেষ নয়। তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেছে দেখে ওই রাতে উক্ত হাসপাতাল থেকে রোগীকে রেফার করে দেওয়া হয় দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতালে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বর্ধমানের হাসপাতাল থেকে অপারেশন ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনও অর্থ দাবি করেনি। এমনকি ডিসচার্জ কাগজে তাঁদের কারও স্বাক্ষরও হাসপাতালে তরফে চাওয়া হয়নি। রেফার অনুযায়ী অচৈতন্য সারহীন পরীক্ষিতবাবুকে রাত তিনটে নাগাদ মিশন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকেই রোগীকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর জানিয়ে দেওয়া হয় রোগীর অবস্থা যথেষ্ট সংকটজনক। ৯০ শতাংশ ব্রেন ডেথ বলা যায়। অবশেষে পরদিন অর্থাৎ ১১ তারিখ সকাল ১০.১৫ মিনিটে পরীক্ষিতবাবুর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। 
অভিযোগের বর্ণনা কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি। অপারেশন থিয়েটারে রোগীর অপারেশনের সময় নিশ্চিত কোনও ত্রুটি হয়। নচেৎ অতি সাধারণ মানের এমন একটা অপারেশনে যাবতীয় মানসিক ও শারীরিক অবস্থা যথেষ্ট সহায়ক থাকলেও কিভাবে কার্ডিয়্যাক প্রবলেম হতে পারে রোগীর। আর তাই যদি হতো তো কেন বর্ধমানের হাসপাতালের তরফে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাকা হলো না পরিজনদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও। এমনকি অপারেশনের আগে মেডিক্লেম না মেনে নগদ অর্থ দেবার দাবি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আবার তারাই কোনওরকম টাকা না নিয়েই রোগীকে ছেড়ে দিল আচমকা তড়িঘড়ি করে। এসব বলতে বলতে মৌমিতাদেবীর আরও বক্তব্য, হয় অপারেশন চলাকালীন শুভ্রাংশুবাবু সঠিক পন্থা অবলম্বন করেননি অথবা অ্যানাস্থেসিয়ার পরিমানে গন্ডগোল ছিল। তাঁর মতে আরও অবাক ঘটনা, ওই হাসপাতাল বলছে কার্ডিয়্যাক সমস্যা অথচ অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা চালাচ্ছেন নিউরোলজিস্ট। গোটা বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধলে মিশন হাসপাতালে আমরা শবদেহ ময়নাতদন্তের দাবি জানাই। কিন্তু মিশন হাসপাতাল এই দাবি প্রাথমিক ভাবে মানতে না চাইলে অগত্যা সংশ্লিষ্ট থানাতে ও মহকুমা প্রশাসন দফতরে সমস্ত ঘটনা নথিভুক্ত করা হয় নালিশ আকারে। এরপর দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। যদিও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এই লেখা চলাকালীন জানা যায়নি। তিনি সরাসরি বলেন, অপারেশন থিয়েটারে ভুল চিকিৎসার কারণে আমার স্বামী মারা গেল। তবে এই অভিযোগ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলি মুখে কুলুপ এঁটেছে।
পরীক্ষিতবাবুর সহকর্মী তথা ওই কলেজের অধ্যাপিকা দেবলীনা গুপ্ত মন্তব্য করেন, আজকালকার দিনে গলব্লাডারে স্টোনের কারণে রোগী মারা গেলে নানা সন্দেহ মনে আসে বৈকি। আমার সহকর্মীর এই মৃত্যু মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। অভিযোগ যখন উঠেছে পুলিশ প্রশাসন স্তরে তদন্ত আশা করবো। এই মৃত্যুর জন্য যদি কেউ বা কারা দায়ী হয় তবে তার শাস্তি কাম্য।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours