ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

করোনা সংকটের মুখোমুখি এখন গোটা বিশ্ব। এ সময়টাতে আমরা বুঝতে পেরেছি, মানুষ আসলে কতো ধরনের প্রবলেম নিয়ে বেচে থাকে। চলমান বিশ্বে কতো শত প্রবলেম ছিল। এখন প্রায় স্থবির বিশ্বে প্রতিদিন দেখা দিচ্ছে নানান সমস্যা। পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে দেশ এবং দেশ থেকে বিশ্ব সবই এক সূত্রে গাঁথা। কোথাও একটি সমস্যা দেখা দিলে তার প্রভাব পড়ে সমগ্র বিশ্বে। 
করোনার প্রধান সমস্যা আর্থিক সংকট। করোনার করাল গ্রাসে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়েছে মিডিয়া সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান। বন্ধ হয়েছে স্টেজ প্রগ্রাম। সেই সাথে বন্ধ হয়েছে শিল্পী, যন্ত্রী এবং এ্যারেঞ্জার হিসাবে কর্মরত মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকলেই এখন বেকার। এরা আর্থিক ভাবে খুবই সংকটে আছে। এরা না পারছে কাউকে মুখ ফুটে বলতে। না পারছে এর সমাধান করতে। এ কারনে মানুষের মধ্যে ফ্রাস্ট্রেশান বেড়ে গেছে। 
ফ্রাস্ট্রেশান অর্থাৎ হতাশা। মনোবিজ্ঞানে বলা হয়ে থাকে, কোন ব্যক্তি যখন তার ইচ্ছা বা আকাঙ্খা বা লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয় তখনই হতাশায় নিমজ্জিত হয়। হতাশা সাধারণত দুই প্রকার- ১. অভ্যন্তরীন, ২. বাহ্যিক। অভ্যন্তরীন ফ্রাস্ট্রেশান হলে ব্যক্তি তার লক্ষ্য, আকাংখ্যা বা প্রয়োজনগুলি পুরণে ব্যর্থ হতে থাকলে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস হারাতে থাকে। এই অবস্থা দীর্ঘ হতে থাকলে মেন্টাল ডিজঅর্ডার হতে থাকে। বাহ্যিক ফ্রাস্ট্রেশান হয় ব্যক্তির শারীরিক অক্ষমতা অনুভব করা বা কারো ইচ্ছা পূরণে ব্যর্থ হওয়া। অথবা কাউকে কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারা। বা সমাজে নিজের সম্মান ক্ষুন্ন হলে। এভাবে ব্যক্তি ধীরে ধীরে নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রন রাখতে পারে না। ফলে রাগ, জেদ, আক্রোশের জন্ম হয়। কখনো কখনো খুন, আত্মহত্যার মতো ঘটনার জন্ম দিয়ে থাকে। অভ্যন্তরীন হাতাশার চেয়ে বাহ্যিক হতাশা মানুষকে খুব বেশি প্রভাবিত করে। 
আমরা অনেক সময় সহকর্মী, বন্ধু, কাছের মানুষ বা রাস্তায় অনেক মানুষকেই দেখি অযথা রেগে যান। আবার কিছুক্ষণ পরে নিজেই ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হন। এসব দেখে ওই ব্যক্তির উপর রেগে না গিয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া উচিত সমস্যার বিষয়। মনে রাখতে হবে এটা হতাশার একটি বড় লক্ষণ। যদি অনুসন্ধান করি তাহলে দেখা যেতে পারে অনেক অদ্ভুত কারন রয়েছে এর পেছনে। 
১. হতে পারে, ওই ব্যক্তিটি উভয়সংকটে পড়েছেন। হতে পারে কর্মক্ষেত্রে প্রবলেম, হতে পারে পারিবারিক প্রবলেম, হতে পারে অর্থনৈতিক প্রবলেম। হয়তো অফিসে তিনি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বেতন বাড়ছে না, প্রমোশন হচ্ছে না। আবার এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না। বললে হয়তো চাকরিটাই থাকবে না। চাকরি চলে গেলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। 
২. হতে পারে, মেয়েটির অমতে বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে এ নিয়ে রাত-দিন কথা শোনায়। যদি সংসার ভেঙ্গে দেয় তাহলে বাবার সম্মান নষ্ট হবে। অথবা নিজে বাঁচার মতো কোন রাস্তা বা আয়ের পথ সে জানে না।  তাই মুখ ফুটে কিছু বলছে না। দিনের পর দিন মুখ বুজে সব সহ্য করে যাচ্ছে।
৩. হতে পারে, পরিবারের অমতে একটি মেয়েকে ভালবেসে বউ করে ঘরে এনেছে। সেই ভালবাসার মেয়েটিকে নিয়ে সর্বক্ষন বাড়ির লোকদের সাথে মনোমালিন্য হচ্ছে। একদিকে ভালবাসার মানুষ। অন্য দিকে প্রিয় মানুষ মা। কোন দিকেই পক্ষ নেয়ার উপায় নাই। দিনের পর দিন মুখ বুজে দুই পক্ষের অভিযোগ সহ্য করে যাচ্ছে।
৪. হতে পারে ব্যবসায় লস করে সাজানো সংসার হঠাৎ করে তছনছ হয়ে গেল। একদিকে অর্থনৈতিক অভাব। অন্য দিকে স্ত্রী-সন্তানকে যে পরিবেশে বড় করেছে সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না চালানো। এ সবই হতাশা জন্ম দেয় মানুষের মনে।
এ কারণ গুলির ফল হিসাবে প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়, অন্যায়, ধর্ষণ, মাদক, হত্যা এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনা। যে ব্যক্তি হতাশায় ভুগছেন তিনি অনেক সময় বুঝতে পারেন না। অনেক সময় বুঝতে পারলেও নিজের ব্যক্তিত্ব বা সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হবার ভয়ে স্বীকার করেন না। এ বিষয়ে পাশের মানুষটিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি বড় কোন প্রবলেম না হয়ে থাকে, তবে ব্যক্তি নিজে বা পাশের মানুষটির সাহায্যে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন। অনেকে মনে করেন সব রোগের মতোই এ রোগে শুধু ডাক্তার দেখানো এবং ওষুধ খেলেই ভাল হয়ে যায়। কথাটা পুরোপুরি সঠিক নয়। এটা যেমন মনের রোগ, তাই এ রোগ থেকে মুক্তিপেতে অবশ্যই মানসিক যত্ন জরুরি।
কেউ যদি এই লক্ষনগুলির কোন একটি বুঝতে পারেন তাহলে দেরি না করে প্রতিকারের ব্যবস্থা করুন। 
১. প্রথমেই আপনার বিশ্বাসী কারো সাথে কথা বলুন। যাকে আপনি সব কথা খুলে বলতে পারেন। হতে পারে মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু বা প্রতিবেশী। অথবা যে বিষয়টি আপনি কারো সাথে শেয়ার করতে পারছেন না, বন্ধ ঘরে আয়নার সামনে নিজেকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকুন। 
২. যদি কারো উপর প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে হয়, তাহলে কয়েকটি কাঁচের গ্লাস মনের সব আক্রোশ নিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে মারতে থাকুন। 
৩. খোলা আকাশের নিচে নির্জন স্থানে চিৎকার করেন। সম্ভব হলে কাঁদতেও পারেন।
৪. অভিযোগ বা মনের অপ্রকাশিত কথাগুলি একটি কাগজে লিখতে থাকুন।
৫. ব্যক্তি নিজের ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করুন।
দেখবেন মন হালকা হয়ে যাবে। এভাবে ধীরে ধীরে মেডিটেশন করার দিকে মনোযোগ দিন। যদি আপনার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকে তাহলে ইন্টারনেটে দেখে নিতে পারেন। প্রত্যেক মানুষের উচিত প্রতিদিন একবার করে মেডিটেশন করা। মেডিটেশন কোন আলাদা বিষয় না। স্বাভাবিক জীবনের একটা অংশ। মেডিটেশন এর অর্থ সারাদিনের কর্ম-ক্লান্তি নিজেকে এক স্বচ্ছতার সামনে দাঁড় করানো। আমার কি করার কথা ছিল, আর আমি কতোটুকু করতে পেরেছি। সব সময় মনে মনে বলবেন ‘হয়তো আমার আরো কাজ করার ছিল কিন্তু যতটুকু পেয়েছি এতে আমি খুশি’। তাহলে আর হতাশার জন্ম হবে না। সর্বপরি ভাবতে হবে, সংকটময় সময় কাটিয়ে উঠতে হবে। এর জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours