সুরঞ্জন কর, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

খুব মন খারাপ ছিল ভাবছিলাম অনেক কথা, হতাশ না হয়ে কিছু পুরনো দিনের কথা মনে হল। কানপুর থেকে কাজ সেরে মাঝরাতে নিউ দিল্লী শিয়ালদহ রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে কলকাতায় ফিরছি !এ সি টু টায়ার স্লীপার কোচে টিকিট বুকিং করাই ছিল !ট্রেন প্রায় এক ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট লেট ! উঠে দেখি কম্পার্টমেন্ট ফাঁকা! একে অফ সিজন তার ওপর শীতের মাঝরাত বলে কথা! ওঠার পর কন্ডাকটর আমাকে একটা আপার বার্থ এ সিট দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলো ! লোয়ার বার্থের নিচে সুটকেস টা রেখে ওপরে উঠে নজর গিয়ে পড়লো পাশের সিটে! একে শীতকাল তার ওপর এ সি কম্পার্টমেন্ট, বেশ ঠান্ডা লাগছে ! পাশের ওপরের বার্থে এক ভদ্রলোক সাদা চাদরের ওপর কম্বল গায়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন আর লোয়ার বার্থে এক ভদ্র মহিলা পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছেন ! দেখে স্বামী স্ত্রী বলেই মনে হলো ! সারা দিন কাজের চাপে ক্লান্ত শরীরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই ! ঘুম ভাঙলো সকালের চা আসার পর!
আমার নিচের বার্থের লোক মাঝপথে নেমে যাওয়ায় নিচের সিট টা খালি ছিল! বাথরুম থেকে মুখ ধুয়ে গরম চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম জালনার ধারে ! উল্টো দিকের মহিলা আগেই উঠে পড়েছেন ! জানালার বাইরের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত! ট্রেন চলছে হু হু করে! শীতের রোদে বাইরের দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগছিলো! মহিলার চেহারা দেখে মনে হলো বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা ! একটু ছোট খাটো চেহারা, গায়ের রং বেশ ফর্সা, চোখে চশমা ! হাতে চায়ের কাপ নিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে ! মনে হলো খুব গভীর চিন্তায় মগ্ন ! বাইরের সুন্দর দৃশ্য দেখেও এতো সুন্দর মহিলার মুখ চোখ কেমন ম্লান! 
এই জায়গাটার গুন এমনই যে এখানে খুব দ্রুত বন্ধুত্ব হয়। কিছুক্ষণ পর ভদ্র মহিলা নিজেই আমার সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। 
একটু আলাপের পর বুঝলাম মাসিমার স্বামীর লিভারে ক্যান্সার হয়েছে, কিছু বিশেষ পরীক্ষার জন্য দিল্লী গেছিলেন। 
বছর দেড়েক আগে ধরা পড়ে ওনার স্বামীর এই রোগ, ওনারা থাকেন শান্তিনিকেতনে ! দুজনেই সরকারি কলেজের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক ! দুই মেয়ে, দুজনেই কর্মরত ছেলেপুলে সংসার নিয়ে তারাও ব্যস্ত ! জামাইয়ের চাকরির সুবাদে ছোটমেয়ে দেশের বাইরে আমস্টার্ডামে থাকে আর বড় মেয়ের শশুর বাড়ি কলকাতায়!
রোগ ধরা পড়তে বুঝলে বাবা, একটু দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম, কলকাতায় চলে এলাম, বড় মেয়ের কাছে উঠলাম, ঠাকুর পুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে ওনার চিকিৎসা শুরু হোল, মাস তিনেক ওনাকে থাকতেও হোল। দিন পনেরো বাদে আমি ফিরে গেলাম শান্তিনিকেতনে ! গিয়ে প্রথমে কি করলাম বলোতো? কাঁচা মাথায় আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, বাড়ি বিক্রি করার কথা ভাবলেন বুঝি? 
না বাবা, একজন চেনা বিশ্বাসী মানুষ কে দোতলা তোলার ভার দিলাম। আমরা তো কলকাতায় বেশি থাকব, বাড়ি ফাঁকা রাখার সমস্যা আছে ! তাড়াতাড়ি দোতলা সম্পূর্ণ করে জিনিসপত্র ওপরে তুলে, একতলাটা ভাড়া দিলাম, এখন বাড়ি নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত। ওবাড়ি আমাদের বড় প্রিয়, তাছাড়া বিক্রি করে দিলে মেয়েদের বাপের বাড়ি বলে কিছু থাকতো না, দুটো তলা হলে দুই মেয়ের ভাগ করতেও সুবিধা। 
বুঝলাম মাসিমা দূরদর্শী মানুষ। 
তারপর কি করলেন?
মাস চারেক বাদে আমরা ফিরে গেলাম। কিন্তু ওনার চিকিৎসার জন্য বারে বারে কলকাতায় আসতে হচ্ছিল, এ তো সহজ রোগ নয়। এসে মেয়ের বাড়ি উঠছিলাম কিন্তু কি জানো বাবা, কোথাও একটু অসুবিধাও হচ্ছিলো মনে মনে। সত্যি বলতে আমার বড় মেয়ে আর জামাইএর কোন তুলনা নেই, বাবার চিকিৎসা মেয়েই তো সব করাচ্ছে আমি কি সব পারি একা?! কিন্তু দুটো বাচ্চা, চাকরি সব নিয়ে ওরা খুব ব্যস্ত, ওদের বাড়ি মাসের পর মাস থাকা কোথাও আমার ঠিক লাগছিল না, তাই কাউকে না বলে নিজেই অন্য একটা ব্যাবস্থা করলাম। ওনাকেও বলেছি সব ঠিক করে নিয়ে। 
কি ব্যবস্থা করলেন মাসিমা? 
একটা ভাল বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে বার করলাম !
আমার চোখ মুখের অবস্থা ঠাওর করতে পেরে বললেন অবাক হলেন বুঝি? বৃদ্ধাশ্রম মানেই খারাপ কিছু নয়। এটা ডায়মন্ড হারবার রোডের ওপর আমতলা থেকে একটু ভেতরে গঙ্গার ধারে । বিশাল জায়গা জুড়ে।, চমৎকার ফুলের বাগান, বড় বড় ঘর, আলো, ফুলের গন্ধ, দোলনা, খাওয়া দাওয়া খুব ভাল। সপ্তাহে একদিন ডাক্তার আসেন। ডরমিটরি ও আছে আবার আলাদা ঘরও নেওয়া যায়। 
ঠাকুর পুকুর ক্যান্সার সেন্টার থেকে খুব একটা দূরেও নয় ! নাম - জাগৃতি ধাম!
মেয়েকে বলতে সে তো কেঁদে একশা। সে ভেবেছে তার ওপর অভিমান করেছি আমি। বুঝিয়ে বললাম, মা রে তোর মত মেয়ে অনেক ভাগ্য করে পেয়েছি, কিন্তু তুই তো তোর মা কে চিনিস, একটু নিজের মত থাকতে ভালোবাসে। অনেক বোঝানোর পরে মেয়ে জামাই বুঝলো। গিয়ে ব্যবস্থা দেখে ওরাও মুগ্ধ। প্রথমে ডরমিটরি নিয়ে একা থাকতে শুরু করি। এখানে শুরু হোল আমার নতুন জীবন।
কি জানো বাবা দেখলাম এত সুন্দর ব্যবস্থা সত্ত্বেও বেশিরভাগ মানুষ ওখানে খুব বিষন্ন। মহিলারা ছেলের বৌ, জামাই দের নিন্দে করছে, পুরুষেরা কর্মজীবন এর সাফল্যের খতিয়ান দিতে ব্যস্ত আর না হয় অসুখ বিসুখ ! এটাই সারাদিনের আলোচনার বিষয় বস্তু। একটা মন্দির আছে তাতে বেশ ভিড়। কিন্তু সবার মুখ শুকনো ! আমি অসুখ বিসুখকে আমল দিতে ভালবাসিনা, সারা জীবন বামপন্থী রাজনীতি তে বিশ্বাসী, ভগবানের সাথে তেমন ভাব ভালবাসা নেই, আর এখানে কাজ কর্ম ও তো নেই কিছু, দুবেলা মুখের সামনে খাবার, বই পড়ে আর কত সময় কাটে। 
তা আমি শুরু করলাম গানের ক্লাস - সবার জন্য। 
বলেন কি মাসিমা ! গাইবে কে? 
শান্তিনিতনে আমি খুব ভাল গাইতাম ! ডিপ্লোমা আছে, মেয়েদের শিখিয়েছি, কলেজেও প্রোগ্রাম করেছি, আবার শুরু করলাম, সপ্তাহে পাঁচদিন, বিকেল বেলা দু ঘন্টা। বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার খুব উৎসাহ দিলেন ! নোটিশ লাগানো হোল, সামান্য ফিজ ও রাখা হোল যদিও টাকাটা আমি নি না, জমা থাকে। একে একে দুয়ে দুয়ে ভর্তি হোল সবাই, প্রথমেই সব পুরুষেরা। কেউই আগে গান বাজনা খুব একটা করেন নি, কিন্তু এখন খুব উৎসাহ।মহিলা রা এলেন পরে। 
দেখো বাবা আমাদের প্রায় সবারই কোমরে ব্যাথা, হাঁটুতে বাত, তা আমি সেরকম বুঝে শুরু করেছিলাম হাল্কা গানের সাথে একটু নাচ, যাতে মন আর শরীর দুটোই কিছুটা ভালো থাকে ! শান্তিনিকেতনে পরা শুনা করায় এই দুটোর ওপরই আমার কিছুটা দখল ছিল ! বিশেষত রবীন্দ্র সংগীতের ওপর ! একসময় প্রাইজও পেয়েছিলাম!
সত্যি কথা বলতে কি, এখন সবার ব্যাথা বেদনা কমেছে শুধুই নয় - কবে নতুন গানের সাথে ,নতুন নাচ দেবো সেই নিয়ে সবাই ব্যস্ত। মনের দিক থেকেও সবাই বেশ চনমনে!
মাসের শেষ রবিবার একটা করে অনুষ্ঠান করি। সবাই নাচ গান করে। তাদের ছেলে মেয়েরা সবাই দেখতে আসে। তারা তো সব অবাক, জীবনে জানতো না যে তাদের বাবা বা মা গান, নাচ জানে ! আমরা এখন রবীন্দ্রজয়ন্তী করি, এসব ছাড়া বাঁচতে পারি না।
আজকাল জানোতো নিন্দে মন্দ সব উধাও, গেলে দেখবে কেউ বাগানের বেঞ্চিতে বসে গান গাইছে, কেউ বা ঘরে বসে নাচের স্টেপ মেলাচ্ছে!এখন তোমার মেসোমশাই ও এসে গেছেন, দুজনে একটা ঘর ও নিয়ে নিয়েছি। 
ট্রেনের জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে গলাটা একটু খাটো করে বললেন - খালি একটাই মুশকিল হয়েছে ! এই প্রথম মাসিমার মুখে মুশকিলের কথা শুনলাম। 
কি মুশকিল মাসিমা?
আর বোলোনা ওখানকার সব কজন পুরুষ মেম্বার এখন আমার প্রেমে পড়ে গেছে। কদিন যদি মেয়ের বাড়ি যাই, অমনি সবাই ফোন করবে, মিসেস মুখার্জী আপনাকে না দেখলে দিন ভাল লাগে না, ফাঁকা লাগে ! এই নিয়ে, মানে তোমার মেসো একটু জেলাস আর কি। 
মাসিমাও হাসছেন আমিও হাসছি। আর চোখে জল আসছে আমার, শিখছি আমি, সমস্ত প্রতিকূলতা কে ভুলে, স্বামীর কঠিন অসুখ সামলে, বয়েস হবার, একা হয়ে যাবার ভয় কে ভুলে একজন রমণী শুধু নিজের সাধারণ বুদ্ধির প্রয়োগ করে সংসারের এক প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূলে এনে হাসি মুখে থাকার আপ্রাণ চেষ্টার কাছে নতজানু হচ্ছি আমি। 
গল্প শুনতে শুনতে বুঝতেই পারিনি ট্রেন উল্টোডাঙা ছেড়ে শিয়ালদহ স্টেশনের নয় নম্বর প্লাটফর্মে ঢুকতে আরম্ভ করেছে !
ভাল থাকুন মাসিমা, আসার আগে প্রণাম করে ট্রেন থেকে নেমে এলাম।
সার্থক হোক আদি অনন্ত এমন পবিত্র নারীজনম...
সকল মহিলা যেন আমার কাছে এক, একই উপলব্ধি।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours