প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

"ভাঙা গড় গড়াইবো, জলপূর্ণ করি 
জলশূন্য পরিখায়, ধনুর্বাণ ধরি দ্বারিগণ 
আবার রক্ষিবে দ্বার, অতিকুতূহলে।" 
"পঞ্চকোটস্য রাজ্যশ্রী আর পঞ্চকোট বিদায়সংগীত"; 
কিংবদন্তী বলে,   সময়টা ৯০ খ্রিস্টাব্দ ; রাজা দামোদর শেখর ছিলেন পঞ্চকোটের রাজা। শোনা যায় যে, ঝালদা অঞ্চলের পাঁচ আদিবাসী সর্দার নিয়ে এই রাজত্ব তৈরি হয়। ", গড় " শব্দটির অর্থ দুর্গ, "পঞ্চ" মানে পাঁচ, "কোট" মানেই গোষ্ঠী। চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,  মন্দির, নিয়েই এই স্থান। বর্গি আক্রমণের এক ভয়াবহ চিত্র, এই গড়পঞ্চকোট জুড়ে শিহরণ জাগায়। 

১৭৪২ সালে ভাস্কর পণ্ডিত চল্লিশ হাজার সেনা নিয়ে বর্ধমানে প্রবেশের পূর্বে গড়পঞ্চকোটে তীব্র আঘাত করে। একপ্রকার নবাব বাহিনির আঘাতের বদলা নিতেই এই তীব্র আক্রমণ। লুঠপাট ও নির্বিচার হত্যায়  রক্তের রঙে রাঙা হয়েই গড়পঞ্চকোটে আক্রমণ। রাণীমহলে তখন ১৭ জন সুন্দরী স্ত্রী। সঙ্গে থাকতেন দাসী সুন্দরী পরিচারিকারা। নারীলোলুপ বর্গিরা সুন্দরীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। উন্মাদের মতো গণধর্ষণ রোধকারীদের স্তন তলোয়ার দিয়ে আক্রোশে কেটে ফেলে। আর বাকিরা!  কি করবে, তারা!  তারাও প্রাসাদে রাখা কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ ও ইজ্জত বাঁচায়। তবে বর্তমান গাইডরা বলেন যে, রাণীরাও নাকি এইভাবেই গহীন কুয়ায় মরণ ঝাঁপ দেয়। 

মৃত্যুর এই ভয়াবহতা এবং লুন্ঠনের রূপ দেখে, মানুষজন পালাতে থাকে। অবস্থা এমন হয় যে, এই মানুষজন গড়পঞ্চকোট থেকে ৩০ কিমি দূরে কাশীপুর থানার একটি গ্রাম সোনাথলি গড়ে তোলে। উল্লেখ্য এই সোনাথলিতে সিংদেও রাজ এস্টেটের ম্যানেজার হয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।আজ খুব জানতে ইচ্ছা করছে কেমন ছিলো " গড়পঞ্চকোট"। 

পঞ্চকোট ছিলো সুন্দরী; ছায়া নিকটে আবেগ নিত্য গৌরব; ছোট্ট ঢিপি ছুঁলেই হাত বাড়িয়ে সৌন্দর্য মেঘমালা; বুনোফুল, খুবলে খাওয়া পাথর, সিধে পাকা রাস্তা ছুঁয়েই আছে পাহাড়ের কোল; পুরাণ বলছে একসময় নাকি জৈন সাধকেরা এখানেই সাধন ভজন করতেন ; এই ২১০০ ফুট উচ্চতায় পাঁচটি চুড়ো বিদ্যমান৷ নীল হলুদের মেঘ চাদর সুখে সবুজ ছায়া আভরণ গড়পঞ্চকোট। বর্ষাকালে প্রকৃতি সুখ তো অপার৷ শাল, মহুয়ার,  অর্জুন সুখের আবাস যদি কেউ খুঁজে পেতে চায়, তবে সবুজের বুকে একটু দেহ এলিয়ে দিলেই হয়তো অতীতকে আগলে নিয়ে সবুজ সমারোহে মন মাতিয়ে দিনাতিপাত করাটা একান্তই উপভোগ্য। 
 দুপাশের সারিবদ্ধ সবুজের তলপেটে হারিয়ে যাওয়াতেই তো ইতিহাস খুঁজে নেবে বেনামী ভ্রমণপিয়াসী মন। ঝরে পড়া পাতার আদর, আগন্তুক সংকোচ মিটিয়ে দেয় বৈভবে। অনুগত করেই সুখ বইতে হয় ;তাই বুঝে প্রেম আরোপের মহালীলা মত্ততা... এই গড়পঞ্চকোট ;  ইতিহাস বলে, ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে এই গড়পঞ্চকোট, রাজধানী হিসাবে পরিত্যক্ত হয়৷ দূর অতীত বলে, এর নাম ছিলো তৈলকম্প। আসলে তেলকূপি নামে একটি গণ্ডগ্রাম আজও আছে। পালসম্রাট রামপাল একাদশ শতকে কৈবর্তরাজ ভীমের হাত থেকে পিতৃরাজ্য বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধার করেন। ১৮৭২ - ৭৩ ডি, বেগলার সাহেব নাকি ভ্রমণ করেছিলেন; তিনি ২৫ থেকে ২৬ টি প্রস্তরখন্ড দেখেছিলেন; একলা পথে মন রাঙানো বাস্তব কদর যদি আধুনিকতা হয়, তবে অতীত তার গৌরব স্মারক রেখেছে মন্দিরগুলিত, আর কর্তৃত্বের শাসনে বলি হয়েছে কাল।  

তথ্যসূত্র বলে, বেগলার সাহেব লিখেছেন, "There are four sets of walls, each within the other, surrounding the kot on the west, south and east, the north being defended by the hill itself. (Report of a tour) ১৮ বর্গকিমি জুড়ে এই গড়পঞ্চকোট নিরাপত্তায় ছিলো পাকা। নিরাপত্তার জন্য সুদৃঢ় প্রাকার ও গড়খাত কাটা হতো। পাহাড়ের ঝর্ণাগুলি থেকে নিঃসৃত হয়ে জলধারা খাতগুলিকে পরিপূর্ণতা দিতো। বাইরের সংযোগের জন্য আঁকদুয়ার, খাড়িবাড়ি, দেশবন্ধদুয়ার ইত্যাদি কয়েকটি দরজা ছিলো।  দরজার পরেই বেশ কয়েক খন্ডহর  পুকুর আছে৷ ষোড়শ শতকের শেষার্ধে রাজা হাম্বির্র রাজ্যভুক্ত ছিলো এই গড়পঞ্চকোট।  এই গিরির ৬০০ ফুট উঁচুতে ছিলো প্রহরীদের বাস৷ এছাড়াও আছে গুপ্ত পথ, রাজঅট্টালিকা আর দেবদেউল, তবে সবই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। রত্না, পীড়া ও চালরীতি নামে এই গড়পঞ্চকোট তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। তবে মন্দিরগুলিতে সাবেকি পীড়ারীতি নজর কাড়ে। 

সময়টা খ্রিস্টীয় প্রথম শতক। পঞ্চকোটে সিংদের রাজত্ব তখন৷ কিংবদন্তী বলে, মধ্যপ্রদেশের ধর থেকে আগত রাজা জগৎ দেও আর তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী  পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে যাচ্ছিলেন। তাঁরপর  পুরুলিয়ার জঙ্গলেই ঝালদায় তিনি পুত্র সন্তান প্রসব করেন৷ রাজা রাণী ভাবলেন সন্তানটি মৃত। কারণ অসুস্থ শিশুটির  তীব্র আর্তনাদ তাঁরা শুনতে পেলেন না। আদিবাসীরা কুড়িয়ে নিলো শিশুটি। শিশুটির নাম দিলো দামোদরশেখর। পরবর্তীকালে সেই হলো আদিবাসীদের রাজা৷ ইতিহাস বলছে সেন যুগে এই বংশের কল্যাণশেখর নাকি বল্লাল সেনেরই জামাই ছিলেন ; যৌতুকে দেওয়া হয়েছিলো কুলদেবী  শ্যামারূপাকে৷ পালযুগে ইছাই ঘোষের ধর্মমঙ্গলের আরাধ্যা  শ্যামারূপা ছিলেন কেঁদুলির দক্ষিণে পাহাড়ি গ্রামে। সেই দেবীকেই  এই গড় পঞ্চকোটে আনা হয়। ভগ্নপীড়ার সেই দেউল আজকের কল্যাণেশ্বরী আদি মন্দির; কোথাও যেন বিজন উদ্যান ছুঁয়েই বিস্ময় পরিবর্তন কল্যাণেশ্বরী; আবেগের ভরা বুকে দীর্ঘ ছায়ায় হয়তো আগাছা এই বুনো বর্গি হাঙ্গামা। 

#ঋণস্বীকার - 
১) বঙ্গে বর্গিহাঙ্গামা ইতিহাস ও কিংবদন্তি.. 
 স্বপনকুমার ঠাকুর 
২) কৃতজ্ঞতা স্বীকার " ব্লগ " অদিতি ভট্টাচার্য
https://blogs.eisamay.indiatimes.com/aditibhattacharya/a-story-of-forgotten-history/
৩) ভক্তিরত্নাকর " শ্রী নরহরি চক্রবর্তী "
৪) "গিরিয়ার প্রথমযুদ্ধের গ্রাম্যকবিতা " মুর্শিদাবাদ কাহিনি, নিখিলনাথ রায়
৫)  ইন্টারনেট  উইকিপিডিয়া 
৬) বর্ধমান সহায়িকা 
৭) অন্নদামঙ্গল কাব্য 
৮)  প্রচলিত লোকগাথা 
৯) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস 
১০) "মহারাষ্ট্র পুরাণ" 
১১) "বণিক বার্তা " ( ইন্টারনেট)  
১২) "বঙ্গদর্শন " ( ইন্টারনেট)  
১৩) ইতিহাস অভিধান 
১৪) পলাশির অজানা কাহিনি,  সুশীল চৌধুরি
১৫) "বঙ্গদর্শন ইতিবাচক বাংলা" 
১৬)  bengali koulal.com
১৭) অন্যান্য 
১৮) আইন-ই- আকবরী
১৯) গড়পঞ্চকোট ( ajanapathe.com) 
২০) ebela.in ও sobBanglay.com

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours