সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর, হুগলি:

মধ্যযুগের বাঙালি কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর স্মৃতি আজ বাঙালির মানসপট থেকে অন্তর্হিত। তাঁর বিখ্যাত রচনা চণ্ডীমঙ্গলকাব্য। অধ্যাপক সুকুমার সেনের ভাষায় -‘এই কাব্য বাঙলার একটা দুর্লভ শ্রেষ্ঠ পাঁচালী’। বলা হয় কাব্যটি প্রাচীন পাঁচালী রচনার মধ্যে সবচেয়ে সুললিত ও  সুমধুর বর্ণনায়। এর রচনাকাল ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোন এক সময় বলে ধারণা করা হয়।  মধ্যযুগে এক অস্থির সময়ে মুকুন্দরামকে দেশান্তরী হতে হয়েছিল। ডঃ সুকুমার সেন কবি জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের প্রবাহধারা দেখে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দের একসময়ে মুকুন্দরামকে সম্ভবত তাঁর পৈতৃক ভিটা পরিত্যাগ করে চলে আসতে হয়। যদিও মতান্তরে বলা হয়েছে, আনুমানিক ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা  অত্যাচারিত হয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন।
মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ( আনুমানিক ১৫৪০-১৬০০ ) পিতা ছিলেন হৃদয় মিশ্র এবং মাতার নাম ছিল দৈবকী। হৃদয় মিশ্র ছিলেন রাঢ় বঙ্গের ব্রাহ্মন। মিশ্র তাঁদের নবাব প্রদত্ত  উপাধি। মুকুন্দরামের পৈতৃক নিবাস ছিল বর্তমান বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে। এখানে উল্লেখ্য আজকের দিনে  মধ্যযুগের কবিদের সম্পর্কে কোন তথ্য প্রমান সেভাবে পাওয়া যায় না। নির্ভর করতে হয় জনশ্রুতি বা পুরুষানুক্রমে চলে আসা বিভিন্ন লোকগাথার ওপর। তাই তাঁদের জীবন রচনায় সঠিকভাবে তথ্য যাচাই করার কোন উপায় নেই। মুকুন্দরামের রচিত চন্ডীমঙ্গল কাব্যের গাথায় যে আত্মজীবনীমূলক তথ্য উপাদান পাওয়া যায় সেগুলিই  তাঁদের জীবনীর উৎস তথা সূত্র প্রদান করে। দামুন্যা গ্রামের জমিদার গোপীনাথ নন্দী নিয়োগী সেলীমাদ শহরে বাসবাস করতেন। সেই কারনে মুকুন্দরামেরা বেশ কয়েক পুরুষ যাবৎ জমির রক্ষক হিসাবে নিয়োগী পরিবারের গ্রামের জমি-জমা দেখভাল করতেন। প্রতিদান স্বরূপ তাঁরাও দামুন্যা গ্রামে পুরুষানুক্রমে জমি-জমা ভোগ করতেন। রাজা মানসিংহ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শাসক নিযুক্ত হওয়ার পর মুকুন্দ রামের জীবনে দুঃসময়ের কালো ছায়া নেমে আসে। জনৈক মামুদ শরিফ ঐ এলাকার ডিহিদার পদে আসীন হন। তিনি অত্যন্ত দুর্বিনীত ও অত্যাচারী জমিদার ছিলেন। তাঁর নির্যাতনে মুকুন্দরাম তাঁর স্ত্রী, শিশুপুত্র ও এক ভাই সমেত গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে ভিটেমাটি ত্যাগ করে গ্রাম ছেড়ে বেড়িয়ে আসেন। পালাবার পথে দামুন্যা থেকে তিন মাইল দূরে রূপ রায় নামে এক ডাকাত তাঁদের সর্বস্ব লুঠ করে নেয়। কয়েকজন পরিচিতের সহায়তায় অসীম কষ্টসহ্য করে কিছুদিন পরে মেদিনীপুর জেলার আড়রা গ্রামে মুকুন্দরাম আশ্রয় নিয়েছিলেন। দামুন্যা থেকে চলে আসার সময় পথিমধ্যে তাঁকে দেবীচণ্ডী স্বপ্নে তাঁর নামে একটি পাঁচালী রচনার আদেশ দেন। আড়রা গ্রামে আসার পথে মুকুন্দরাম ঘাটালের চন্দ্রকোনায় ভান রাজাদের রাজত্ব অতিক্রম করে এসেছিলেন। ভান রাজারা ছিলেন মুঘল সম্রাটদের অনুগত। সেই কারনে তিনি সেখানে আশ্রয় না নিয়ে জেলার সীমানা পেরিয়ে শিলাই নদী  অতিক্রম করে দূরবর্তী আরা গ্রামে জমিদার বাঁকুড়া রায়ের দ্বারস্থ হন। এই জায়গাটি তখন  উড়িষ্যা রাজ্যের মধ্যে রাড় ও ঊড়ীষ্যার সীমানায় ছিল। ব্রাহ্মনভূমের জমিদার বীরমাধবের রাজত্ব ছিল আড়রায়। তাঁর পুত্র ছিলেন বাঁকুড়া রায়। কবিকঙ্কণের কাব্যে উল্লেখ আছে “আড়রা ব্রাহ্মণভূমি/ব্রাহ্মণ যাহার স্বামী/ নরপতি ব্যাসের সমান”।  
রাজা বাঁকুড়া রায় কবিকে তাঁর পুত্র রঘুনাথের গৃহ শিক্ষকরূপে নিযুক্ত করেন। রঘুনাথ তাঁকে গুরুরূপে গ্রহন করেন এবং তাঁর  অনুরোধে মুকুন্দরাম বিখ্যাত কাব্য চণ্ডীমঙ্গল রচনা করেন। মুকুন্দরাম তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের  নামকরণ করেন অভয়ামঙ্গল ও অন্বিকামঙ্গল। রাজা রঘুনাথ কবিকে তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কবিকঙ্কণ’ উপাধি দান করে বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন। একটি পুঁথিতে পালাগায়েনের কথায়, -মুকুন্দ রচিত পুঁথি / শুনি সুখে  নরপতি / খ্যাতি দিল  শ্রীকবিকঙ্কণ। তাঁর পূর্ণ নাম হল কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। তবে এই রচনাকে কোন কোন পণ্ডিত ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’ও বলেছেন। ‘কবিকঙ্কণ’ শব্দের মানে যে কবি হাতে অথবা পায়ে ঘুঙুর পরে গান করেন। সুতরাং বলা যেতে পারে, মঙ্গলকাব্যের কবি ছিলেন পেশাদার গায়ক। তিনি তাঁর কাব্যে গ্রামবাংলার সমাজ জীবনের উপন্যাসের চিত্রটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আধুনিক সাহিত্য সমালোচকেরা মুকুন্দরামের কাব্যের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন-‘ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী মধ্যযুগে জন্মগ্রহণ না করে আধুনিকযুগে জন্মগ্রহণ করলে তিনি কাব্য না লিখে উপন্যাস লিখতেন’। তাঁর কাব্যখানি করুণ রসে সিঞ্চিত প্রাচীন গ্রামবাংলার একটি সর্বাঙ্গসুন্দর সামাজিক চিত্র।
পাঁচালীর কাহিনী তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রথম  অংশে দক্ষের বিরাট যজ্ঞ এবং উমার মৃত্যুর কাহিনী বর্ণিত আছে। দ্বিতীয় অংশে শিকারী কালকেতু ও তার স্ত্রী ফুল্লরার জীবন কাহিনী এবং চণ্ডী পূজার প্রচলন কালকেতু কীভাবে পৃথিবীতে শুরু করেন তার মাহাত্ম্য এখানের মূল প্রাতিপাদ্য বিষয়। তৃতীয় অংশে ধনপতি সওদাগরের শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্য যাত্রার কাহিনী এবং বিজয় সিংহের লঙ্কা বিজয় উপখ্যান সুন্দরভাবে উল্লেখ আছে। এই পাঁচালীতে চণ্ডীদেবীর মাহাত্ম্য  প্রচার হলেও সমকালীন সমাজ ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীকে তিনি  উপেক্ষা করতে পারেনি। তাঁর নিপুন পর্যবেক্ষণ শক্তি,  সহজ- সরল জীবন এবং সংসার জীবনের অভিজ্ঞতা  তাঁর কাব্যকে উপন্যাসের  রং-এ রাঙিয়েছে। মুরারি শীল, ভারু দত্ত ও ফুল্লরা চরিত্র বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। এই কারনে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলকে বলা যায় বাংলা সাহিত্যের  মধ্যে নতুন এক আস্বাদের যোগান দিয়েছে। মুকুন্দ রাম শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, আজন্ম দেবতার সেবা করেছেন। তাই তাঁর সহানুভূতি থেকে বনের তুচ্ছতম পশু কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ কেউই বঞ্চিত হয়নি। লোক ব্যবহার, ছেলেখেলা, ঘরকন্নার ব্যাবস্থা, অনপ্রেক্ষিত সামাজিক ও সাংসারিক ব্যাপারেও  তিনি বিস্ময়কর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।
মুকুন্দরামের কাব্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হোল, এখানে নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে হিন্দুধর্ম গ্রহণের প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে। চৌদ্দশতকের পূর্বে বাংলায় এই মানুষেরা কোন ধর্মের প্রতি অনুরাগী ছিলেন না। পরবর্তী সময়ে দরিদ্র ব্রাহ্মনেরা পাঁচালী রচনার মধ্যে দিয়ে  স্থানীয় দেব-দেবীকে পৌরানিক আখ্যানে উপাসক  হিসাবে বর্ণনা করেছেন। সেইকারনে নিম্নবর্গের মানুষেরা হিন্দুত্বকে তখন ধর্ম হিসাবে গ্রহন করেছিল। এক্ষেত্রে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের আখ্যান একটা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। তিনি সে সময়কার জনজীবনের করুণ চিত্র, যৌথ পরিবারের সমস্যা, দরিদ্র ও ধনী উভয় শ্রেণীর বাস্তব জীবন কাহিনীর দ্বন্দ্ব তাঁর কাব্যে উল্লেখ করেছেন। এইকারনে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী দুঃখবাদের কবি হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছেন।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours