সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

বিধানচন্দ্র রায়ের জীবন পর্যালোচনা করলে কিন্তু দেখা যায়, আজ যে আধুনিক বাংলায় বসবাস করি সেটা কিন্তু বিধানবাবুর নিজের তৈরি। তা কলকাতা বন্দর হোক, লবণহ্রদ বা কল্যাণীর মতো উপনগরী হোক, দুর্গাপুর-আসানসোলের মতো শিল্পাঞ্চল হোক, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে কলকাতার বিমান সংযোগ হোক, সব কিছুরই স্থপতি বিধানচন্দ্র রায়।
বিধানবাবু যা করে গিয়েছেন, তা করে গিয়েছেন। তার পর আর কী হয়েছে? তবু বুদ্ধবাবু সিঙ্গুরে টাটার কারখানা করতে চেয়েছিলেন। সেটিও রাজনৈতিক বিতর্কে বাস্তবায়িত হয়নি।

প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এলে বিধানবাবু তাঁর সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক শিল্প সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। দুর্গাপুর উপনগরী নির্মাণ এবং তার সম্প্রসারণ তো এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। দুর্গাপুরের শিল্পকেন্দ্রগুলিকে ঘিরে উপনগরীকে গড়ে তুলতে যে ধরনের রাস্তা, পার্ক, ক্রীড়া উদ্যান, বেচাকেনার শ্রেণিবদ্ধ দোকান-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির নকশা— সমস্ত খুঁটিনাটি বিধান রায় নিজের চোখে দেখে সিদ্ধান্ত নেন। সময় ও জনসংখ্যার সঙ্গে তাল রাখতে দুর্গাপুর রেলস্টেশন সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। জিটি রোড থেকে প্রশস্ত চার লেনের সড়ক, দুর্গাপুর স্টেশনে রেললাইনের উপরে যে ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে তার খরচ রেল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও দুর্গাপুর ইস্পাত নির্মাণ কর্তৃপক্ষ বহন করবেন। ওভারব্রিজ তৈরির এক-তৃতীয়াংশ ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হলেও কেন্দ্র পশ্চিবঙ্গ সরকারকে জানিয়ে দেয়, এত টাকা কেন্দ্রের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। বিধানচন্দ্র এতই চটে যান যে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারি-কে ফোন করে বলেন, “তোমরা দিল্লির নেতারা কলকাতার মধু নিতে খুব পটু আর পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়ার ব্যাপারে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি? এ ভাবে চলবে না। আমি জওহরকে বলছি।” ব্যস। এর পর নেহরুর কাছে নালিশ এবং ফের রাজ্যের জন্য অর্থ বরাদ্দ। বিধাননগরে থেকে দণ্ডকারণ্য প্রকল্প, সবই ছিল বিধানবাবুর ভাবনা।

চীনের সঙ্গে যুদ্ধের পরে দেশে ভয়ানক চালের আকাল দেখা দিয়েছিল, সেই সময় নেহেরু বিধানবাবুকে বলে - রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের যতটা চালের বরাদ্দ তা কিছুদিন দেওয়া সম্ভব নয়। ... তার বদলে বিধানবাবু যেন গম দিয়ে কাজ চালিয়ে নেন। ... কারণ নেহরুর কাছে ভাত এবং রুটির মধ্যে হয়ত বিশেষ পার্থক্য ছিল না - ভাতের যে গুরুত্ব একজন বাঙালির কাছে। ... বিধানবাবু বাঙালির কাছে ভাতের কি দুর্বলতা, তা বিলক্ষণ জানতেন। ... তাই তিনি অস্থায়ী পদে প্রায় ২৫০-৩০০ যুবক-যুবতী নিয়োগ করলেন। ... তাঁদের দায়িত্ব দিলেন প্রায় 'আদমশুমারির মতই' বাড়ি বাড়ি গিয়ে গিয়ে বাংলায় ভাত এবং রুটি প্রধান খাদ্য কত মানুষের তার পরিসংখ্যান বার করতে। ... ঠিক ৩ মাস পরে সেই পরিসংখ্যান হাতে পেয়েই - বিধানবাবু নেহরুকে চিঠি লিখেছিলেন - "আপনি বাংলায় রুটি যাঁদের প্রধান খাদ্য তাদের দায়িত্ব নিন, আমার পক্ষে তাদের খাদ্য যোগান সম্ভব নয়, আর বাংলায় ভাত যাঁদের প্রধান খাদ্য তাদের দায়িত্ব, আমি বুঝে নেব।" .... নেহেরু বিধানবাবুকে বিলক্ষণ চিনত - তাই বেগতিক দেখে, নেহেরু বাংলার জন্য চালের পুরো মাত্রই বরাদ্দ করতে বাধ্য হয়েছিল। ... তা এই ছিলেন বাংলা প্রকৃত দরদী শ্রী বিধান চন্দ্র রায়

একটা খুব পুরোনো কাহিনী দিয়ে। ব্রিটিশ আমল। মেডিকেল কলেজের তৎকালীন প্রোফেসর কর্ণেল পেকের ফিটন একটি ট্রামে ধাক্কা দেয়। মেডিকেল কলেজে এক এম বি ফাইনাল ইয়ারের মেধাবী ছাত্র সাহেবের সাথে ছিল। সাহেব তাঁকে আদেশ করলেন, তুমি সাক্ষ্য দাও দোষ ট্রাম ড্রাইভারের। ছাত্রটি এই কাজ করতে অস্বীকার করল। কোনো আদেশ, অনুরোধ, লোভ, ভীতি প্রদর্শন তাঁকে টলাতে পারল না। ফল যা হওয়ার হল। এম বি তে ছাত্রটি ফেল করল। বহুযুগ পরে, এক তরুণ বিরোধী দলনেতা মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসা এই ছাত্রটিকে একান্ত আলাপচারিতায় জানতে চান, তাঁর এটা নিয়ে কোন আফসোস আছে কিনা, যশোররাজ প্রতাপাদিত্যর বংশধরের কাছ থেকে উত্তর আসে - 'বিন্দুমাত্র না, বিন্দুমাত্র না।'

গাঁধীজি এক বার বিধানচন্দ্র রায়কে বলেছিলেন, “আহা আপনি যুক্ত প্রদেশের (অধুনা উত্তরপ্রদেশ) গভর্নরের পদগ্রহণ করতে রাজি হলেন না। আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ বলে ডাকার সুযোগ পাব। তা হতে দিলেন না!” বিধানবাবু হেসে জবাব দেন, ‘‘আমি আপনাকে আরও ভাল বিকল্প দিতে পারি। আমি পদবীতে রয়, তাই আপনি আমাকে রয়্যাল বলতে পারেন। আর যে হেতু অনেকের চেয়ে লম্বা, সে হেতু আপনি আমাকে রয়্যাল হাইনেস বলতে পারেন! সেটা কিন্তু যথার্থই হবে।’’ সে দিন বিধান রায় গভর্নর হতে রাজি হননি। পরবর্তী কালে তিনিই হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪৮ সালে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে সরিয়ে তাঁকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়।
শ্রদ্ধেয় বিধানচন্দ্র রায় তখন বাংলার মুখমন্ত্রী আর বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসু, একটা বিল পাশ করা নিয়ে বিধানসভায় তুমুল বিতণ্ডা হচ্ছে, সেই সময় বিধান বাবু বিধানসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, বক্তৃতার মাঝ পথে জ্যোতি বাবু দাঁড়িয়ে উঠে বিধানবাবুর উদ্দেশ্যে বলেন “আপনি তো হিটলারের মতো কথা বলছেন” মুচকি হেসে বললেন ঠিক তাই, হিটলার স্টালিনের সাথে কথা বলছে। এমনই ছিল মুখ্যমন্ত্রী আর বিরোধী দলনেতার সম্পর্ক।

ডঃ বিধান চন্দ্র রায় জ্যোতিবাবুর শুধু পারিবারিক বন্ধু নয় অবিভাবকও ছিলেন। শোনা যায় কোন একসময় মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার দেখিয়ে জ্যোতিবাবুকে বলেছিলেন আমার পরে তুমি এই চেয়ারে বসবে। আসলে তখনকার দিনে রাজনীতিতে শিক্ষিত মানুষরাই বেশী করে আসতেন, এখন তো চোর জোচ্চোর অশিক্ষিতদের ভিড় বেশী।

বাবা বলতেন এই নিয়ে ক্যুইজ করা যায়, কলকাতার সব চেয়ে বিখ্যাত ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম কী? প্র্যাকটিস জমাবার প্রথম পর্বে বিধানচন্দ্র রায় যে কলকাতায় পার্ট টাইম ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিলেন এই গল্প আমি শুনেছি। চালক ও মালিক হিসেবে মোটর গাড়ি সম্বন্ধে তাঁর আজীবন আগ্রহ ছিল।এবং নিজেও ড্রাইভ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। বাবার হাতের আঁকা বিধান রায়ের ছবি একটি পিছনে ব্যান্ডেজ চিটানো বড় খামের উপর তা কালো ফ্রেমে বন্দী ছিলো... দুর্ভাগ্য সেটা সংরক্ষণ করতে পারিনি। জনৈক কোন একজন অফিসের বড় বাবু নিয়ে গিয়েছিলেন সযত্নে। 

পাড়ার মুখার্জী জেঠুর কাছে গল্প শুনতাম, বিধানচন্দ্র যখন কলকাতার মেয়র, তখন (1931) কবিগুরুর সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেখানে কবিগুরুর উত্তর আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।"এই পুরসভা আমার জন্মনগরীকে আরামে, আরোগ্যে, আত্মসম্মানে চরিতার্থ করুক, ইহারা প্রবর্তনায় চিত্রে, স্থাপত্যে, গীতিকলায়, শিল্পে এখানকার লোকালয় নন্দিত হউক, সর্বপ্রকার মলিনতার সঙ্গে সঙ্গে অশিক্ষার কলঙ্ক এই নগরী স্খালন করিয়া দিক পুরবাসীর দেহে শক্তি আসুক, গৃহে অন্ন, মনে উদ্যম, পৌরকল্যাণ সাধনে আনন্দিত উত্‍সাহ। ভ্রাতৃবিরোধের বিষাক্ত আত্মহিংসার পাপ ইহাকে কলুষিত না করুক শুভবুদ্ধি দ্বারা এখানকার সকল জাতি, সকল ধর্মসম্প্রদায় সম্মিলিত হইয়া এই নগরীর চরিত্রকে অমলিন ও শান্তিকে অবিচলিত করিয়া রাখুক, এই কামনা করি।"

বিধান চন্দ্র রায় স্মৃতি রক্ষা কমিটির (ডিপিএল) এক অনুষ্ঠানে  জেনেছিলাম বিধানচন্দ্র রায়ের আরেকজন প্রিয় রোগী ছিলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুজনার মধ্যে ছিল এক মধুর সম্পর্ক। চিত্তরঞ্জন দাশের মহাপ্রয়াণের পর দেশবন্ধুর একটা ছবি বিক্রি করে তিনি কিছু টাকা তোলবার পরিকল্পনা করেন। ছুটে গেলেন কবিগুরুর কাছে। গিয়ে বললেন- ছবিতে দুটো লাইন লিখে দিতে। কবি বললেন, "ডাক্তার, এ তো প্রেসক্রিপশন করা নয়। কাগজ ধরলে আর চটপট করে লেখা হয়ে গেল।"

কিন্তু ডাক্তার নাছোড়বান্দা- সকাল, দুপর, সন্ধ্যা বয়ে যায়। কবি আর কিছুই লিখেন না। বারবার দেশবন্ধুর ছবির দিকে চেয়ে থাকেন। লিখতে গিয়ে আর লিখতে পারেন না। অবশেষে লিখলেন- সেই বিখ্যাত অপূর্ব লাইন দুটি। যা আজো মানুষের মুখে মুখে ফিরে।

"এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।"

আজ জানিনা মানুষ টিকে কতটা সম্মান দিতে পরলাম? যখন তাঁর স্বপ্নের দুর্গাপুরে বসে এই কথা লিখছি তখন এই একটা যন্ত্রণা তারা করে যাই এক সময়ে বিরোধীতার কারণে এই মানুষটির আবক্ষমুর্তি ভেঙ্গে দিয়ে যে অসম্মান করেছিলো তাতে তাঁর প্রতি আর দুর্গাপুরের ভারি শিল্পের প্রতি কতটা সুবিচার করলেন জানতে ইচ্ছা করে।
ইচ্ছা করে আজকের নব রূপকার আপনার শিল্প তালুক রাঢ় আজ অজানা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। আজ দুর্গাপুরের ভাগ্য বিধান করতে আপনাকে ভীষণ দরকার। 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours