শৌভিক রায়, লেখক ও শিক্ষক, কোচবিহার:
করোনার প্রকোপ যত বাড়ছে, তত আমরা অমানবিক হচ্ছি। আর এই অমানবিকতার ছাপ পড়ছে আমাদের নিত্য ব্যবহার ও যাপনে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। দিনদিন আমরা বড় বেশি স্বার্থপর হয়ে উঠছি। চিন্তা করছি শুধুমাত্র নিজেদের নিয়ে। হয়ত করোনাকালীন পরিস্থিতিতে এরকম হওয়া ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু আদতে তা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিপন্থি নয়।
'অতিথি দেব ভবো' যে দেশের অন্যতম শ্লোগান, সে দেশে ভিন প্রদেশ থেকে নিজের ঘরে ফেরা মানুষেরা, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে এরকম 'তফাত যাও দূর হটো' ব্যবহার পাবেন, সেটা একদমই অকল্পনীয়! করোনা মহামারী সেই অভাবনীয় ব্যাপারটিও ক'রে দেখালো। এখানেই বোধহয় মানবতাকে হারিয়ে মহামারীর বিজয়যাত্রার সদম্ভ নিনাদ ঘোষিত হচ্ছে!
নিজেদের ঘরে ফেরা শ্রমিকেরা-সহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, কিছু সংখ্যক আতঙ্কিত মানুষের কাছে যে ব্যবহার পাচ্ছেন, তা শুধু অপ্রত্যাশিত নয়, একান্তই ন্যক্কারজনক। মানছি যে, আতঙ্কিত মানুষেরা খানিকটা দায়ে পড়েই এই ব্যবহার করছেন, কিন্তু এটা তো বোঝা উচিত যে, এই মানুষগুলি যাবেন কোথায়! ভিন প্রদেশ থেকে নিজেদের বাড়িতে ফেরা ছাড়া তাদের বিকল্প আর কোন্ পথই বা খোলা রয়েছে!
ভিন প্রদেশ থেকে ফেরত আসা মানুষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার যারা করছেন তাদের যুক্তি হল যে, অন্য রাজ্য থেকে এসে এরা করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছেন। তাদের কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। উল্টে বহুলাংশেই তাদের কথা ঠিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, যারা অন্য রাজ্য থেকে ঘরে ফিরছেন তারা সকলেই করোনা ভাইরাস বহন করছেন না। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ কেউ সংক্রামিত হয়েছেন। তাই কিছু কিছু মানুষের জন্য সবাইকে দায়ী করা ঠিক নয়। অথচ সেটাই করা হচ্ছে। আবার, কেউ করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হলেই তাকে ও তার পরিবারকে গণশত্রু ভাবার কোনও কারণ নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিটি চিকিৎসায় ঠিক হবেন না, এমনটিও নয়। বরং তথ্য বলছে যে, এই রোগে সেরে উঠবার হার, মৃত্যুহারের চাইতে অনেক বেশি। আমরা অনেকেই বোধহয় এটা ভুলে গেছি। একটা অদ্ভুত 'গেল গেল' রব উঠেছে চারদিকে। এমন কি, করোনা সংক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ সেরে ওঠা কেউ কেউ সামাজিক প্রতিরোধের সামনে পড়ছেন। এ এক অস্বস্তিকর অবস্থা। এই সমাজ কি আদৌ আমাদের চেনা? আমরা কি ভুলে যাচ্ছি যে, রোগ কেউ ইচ্ছে করে বাঁধায় না! কে চায় অসুস্থ হতে? তাও আবার করোনার মতো অতিমারী রোগের হাতে! তাই, কেউ করোনা আক্রান্ত হলেই তার সঙ্গে একজন সমাজবিরোধীর মতো আচরণটি কখনই সমর্থন করা যায় না। বরং ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে, রাস্তাঘাটে যত্রতত্র যারা নির্বিচারে থুতু ফেলে চলেছেন, তারাই আসল অপরাধী। বারংবার বলা সত্বেও মুখে মাস্ক না পড়ে, সামাজিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি না মেনে, যারা বিনা প্রয়োজনে সর্বত্র বিরাজমান তারাই আসল কালপ্রিট। কিন্তু চিত্রটা ঠিক উল্টো। ভাবতে বিষন্ন হতে হয় যে, যারা জীবন ও জীবিকার স্বার্থে দিনের পর দিন বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পড়েছিলেন, আজ তারাই 'নিজবাসভূমে পরবাসি' হয়ে গেলেন! মহামারীর মার একেই বলে!
শুধুই কি ভিন রাজ্য থেকে ফিরে আসা মানুষেরা এই দুর্ব্যবহারের মুখোমুখি হচ্ছেন? স্বীকার করতে ভীষণ লজ্জা লাগছে যে, আমরা ছাড় দিচ্ছি না সেইসব মানুষদের, যারা প্রত্যক্ষ লড়াই করছেন করোনার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে কর্মরত নার্সদেরকে পাড়ায় বা নিজের বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগও কিন্তু উঠেছে। বিশেষ করে যারা বাড়ি ভাড়া করে থাকেন, তাদের বোধহয় বেশি করে সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এটা কি আদৌ কাম্য? যাদের হাতে আমাদের সুরক্ষা তারাই যদি সামাজিক বয়কটের মুখে পড়েন, তবে আর যা হ'ক সেই সমাজকে বিবেচক বলা চলে না। বলতে দ্বিধা নেই যে, অন্য রাজ্য থেকে এই রাজ্যে কাজ করতে আসা নার্সরাই বেশি পরিমাণে এই ব্যবহার পাচ্ছেন। অথচ তাদের ওপর এই রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অনেকটা নির্ভরশীল। তাদেরকে এভাবে অচ্ছুৎ করে দেওয়া মানে প্রকারন্তরে নিজের বিপদ ডেকে আনা।
আসলে বিগত মাস তিনেকের মধ্যে করোনা আমাদের ভাবনা-চিন্তা থেকে শুরু করে সবকিছু পাল্টে দিতে পেরেছে। তাই বোধহয় আতঙ্কের এক অদেখা চেহারা প্রতি মুহূর্তে আমাদের সঙ্গী হয়ে গেছে। আমরা আমাদের মানসিক স্থৈর্য্য চটজলদি হারিয়ে ফেলছি। আর তার ছায়া পড়ছে আমাদের নিত্য ব্যবহারে। করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে এটাই 'অ্যাডভান্টেজ করোনা' এই মুহূর্তে। তা না হলে বিশ্বাস করা কঠিন হয় যে, প্রিয়তম বন্ধুটিও ঘরে ফেরা তথাকথিত শ্রমিকটির বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে গ্রামছাড়া করতে উদ্যোগী হয়েছে। ভাবতে মন চায় না যে, করোনা থেকে সেরে ওঠা যুবককে বাড়ি তো দূরে, পাড়াতেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না!
অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইটি সম্মিলিত। সামাজিক ও দৈহিক দূরত্বের মাধ্যমে সকলে মিলে এমন এক বৃত্ত সৃষ্টি করা, যেখানে করোনা তুচ্ছ প্রমাণিত হবে। কোনভাবেই এই দূরত্ব কাউকে বয়কট করা বা একঘরে করে দেওয়া হতে পারে না। তাকে গণশত্রু প্রতিপন্ন করাও হতে পারে না। মনে রাখতে হবে যে, করোনা সংক্রামিত ব্যক্তিটিও সমাজের অন্তর্ভূক্ত। তার সংক্রমণের বা আক্রান্ত হওয়ার দায় কিন্তু শুধুমাত্র তার একার নয়। বৃহত্তর সমাজও সেই দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তাকে সম্পূর্ণ বয়কটের মাধ্যমে রোগ উপশমের কথা ভাবলে, একদিন এমনও আসতে পারে যেদিন হয়ত নিজেকেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে!
বরং করোনা প্রশমনে অনুপস্থিতির মধ্যে দরকার এমন এক উপস্থিতি, যা পারস্পারিক সাহচর্য ও প্রত্যয়কে বৃদ্ধি করবে। এভাবে সামাজিক বয়কট পরিস্থিতিকে কেবল জটিল করবে, লাভের লাভ কিছু হবে না। প্রয়োজনে অবশ্যই কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন ইত্যাদি সব করতে হবে, কিন্তু শুধুমাত্র আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মরবার আগে বারবার মরলে ও মারলে সামাজিক সুস্থিতি যেমন নষ্ট হয়, তেমনি মনুষ্যত্বেরও অবমাননা হয়। বিপদের এই সময়ে, আমরা যদি এই বোধটুকুও হারাই তবে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না! করোনার বিপদ একদিন ঠিকই কেটে যাবে, কিন্তু মনুষ্যত্বহীন জীবন নিয়ে কি হবে?
অবিলম্বে এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে আগামী দিন ভয়ঙ্কর হতে চলেছে। এমনও হতে পারে যে, এরপর আমরা নিজেদের মানুষকেও চিনব না, জানব না।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours