প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
হিউয়েন সাং, যে দেশ ভ্রমণ করেছিলেন, তা তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ; আজ বুদ্ধভারতের আলেখ্য এঁকে দিয়ে যাই সেকাল সমগ্র কথন। প্রায় ২০০০ লি এবং রাজধানী জুড়ে ১০ লি পরিধি বিশিষ্ট তক্ষশীলা। এ দেশ প্রথমে কপিশা রাজ্যের অধীনে ছিলো , বর্তমানে কাশ্মীরের অধিকারভুক্ত। নাতিশীতোষ্ণ এই দেশে ফুলে ফলে বসুন্ধরা জননী সাকার।
এই স্থানে অনেকগুলি নদী ও উৎস বিদ্যমান। তক্ষশিলায় মহাযানীদের বাস, তবে বর্তমানে জনশূন্য সঙ্ঘারাম আজও ইতিহাস আচরণে ভাসে। রাজধানীর দিকে তাকালে ৭০ লি উত্তর পশ্চিমে নাগরাজ ইলাপত্রের সরোবর অবস্থিত৷ এই জল নাকি বড়ো মিষ্ট এবং পবিত্র। এই নাগ পূর্বে ব্রাহ্মণজাতীয় হলেও, কশ্যপ বুদ্ধের সময় ইলাপত্র বৃক্ষ নষ্ট করতো। তাই তো জলের প্রয়োজন হলেই, এই দেশের অধিবাসীরা শ্রমণগণের সাথে সরোবরের তীরে অবস্থিত হয়ে প্রার্থনা করতো।
নাগ সরোবরের ৩০ লি দক্ষিণ পূর্বে দুই পর্বতের মধ্যস্থলে গিরিসঙ্কটে একটি অশোকের স্তূপ বিদ্যমান। এই স্তূপ প্রায় উচ্চতায় ১০০ ফুট। শোনা যায় বুদ্ধ বলেছিলেন, পৃথিবীপতি মৈত্রেয় এই জগতে আবির্ভূত হলে, তাঁর সঙ্গে চারটি রত্নও আপনা হতে আবির্ভূত হবে। এই চারের একটি এই দেশেই থাকবে। চতুর্দিক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলেও এই স্থানের একশত পাদভূমি বেষ্টম করে কোনো আন্দোলন হয় না। কি আশ্চর্য তাই না! কেবলমাত্র কোনো ব্যক্তি ঐ স্থান খনন করলে তবেই ভূমিকম্প হয়।
নগরের উত্তরে ১২|১৩ লি দূরে আশোরাজের নির্মিত স্তূপ ঘিরে কতো জনশ্রুতি আছে। এক কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্থ স্ত্রীলোক ঐস্থানে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করতেন এবং নিজের সব পাপ স্বীকার করে নেন৷ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর লাবণ্যময় দেহ হতে নীলপদ্মের গন্ধ বিকীর্ণ হতে থাকে৷ আসলে ঐ স্থলেই তথাগত বোধিসত্ত্বরূপে বিনয় শিক্ষা করেছিলেন৷ তিনি তখন চন্দ্রপ্রভা নামে সেখানের রাজা ছিলেন৷ বোধি লাভের জন্যই তাঁর মস্তকছেদন আর বার বার জন্মগ্রহণ।
অশোকের নির্মিত স্তূপে অন্ধ মানুষ প্রার্থনা করলে অন্ধত্ব ঘুঁচে যেতো৷ শোনা যায় নগরের দক্ষিণপূর্ব পর্বতপার্শ্বে ১০০ ফুট উঁচু এক স্তূপ আছে। সেখানেই কুনালের চক্ষু উৎপাটিত হয়৷ সে ছিলো এক পাটরাণীর সন্তান। পাটরাণীর মৃত্যুত পর স্থলাভিষিক্ত রাণী তাঁকে কুপ্রস্তাব দেয়। কিন্তু কুনাল তাঁকে তিরস্কার করে৷ বিমাতার কুদৃষ্টিতে কুনালকে তক্ষশীলায় পাঠানো হয় এবং তাঁরই স্বীয়শক্তির সাহায্যে কুনালকে দোষী সাবস্থ করে চক্ষু উৎপাটনে নির্দেশ দেওয়া হয়। রাণীর পাঠানো পত্রে দন্তের মোহর দেখে কুনাল নিজেও স্থির হন যে, এটা কেবল বিমাতার নয়, তাঁর পিতারও ইচ্ছা । এরপর কুনাল দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে ভিক্ষা করতে থাকে। পরে অবশ্য রাজা বুঝতে পারেন যে তাঁর দ্বিতীয় পত্নী কুনালকে এমন করেছেন, তখন তিনি রাণীকে হত্যা করতে আদেশ দেন৷
বোধি বৃক্ষের কাছে সংঘরাম ঘোষ নামে এক অর্হৎ বসবাস করতেন৷ ত্রিবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। কুনাল সহ একদিন অশোক সেই অর্হৎ এর কাছে এলেন। অর্হৎ সব শুনে সকলকে চক্ষু জল রাখবার একটি পাত্র আনতে বললেন৷ শুরু হলো ধর্মপ্রচার কাহিনি; দ্বাদশ বর্ষ ধর্মপ্রচারের কথা শ্রবণ করলে সকলের চোখ হতে জল গড়াতে থাকে৷ সকলে জল নিয়ে একটি সুর্বণপত্রে রাখলেন। সেই জলে কুনালের চোখ ধুতেই সবটুকু আগের মতো হয়ে গেলো। শেষটুকু মাহত্ব রেখেই হিউয়েন সাং ৭০০ লি দক্ষিণ পূর্বে সিংপুর রাজ্যের দিকে প্রস্থান করেন।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours