সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর, হুগলি:

 ইংরেজ শাসকগণ এদেশে শাসন বিস্তার করলেও বঙ্গদেশে শিক্ষাবিস্তারে তাদের কোন মনোযোগ  ছিলনা। বাণিজ্যবিস্তারই ছিল তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। ওয়ারেন হেস্টিংসই প্রথমে এই দেশে শিক্ষাবিস্তারের ব্যাপারে অগ্রসর হন । তাঁর মতে, “যাহারা দুর্বল তাহাদের রক্ষা করা মনুষ্যত্বের পরিচায়ক, যাহারা ক্ষতিগ্রস্থ, তাহাদের ক্ষতিপূরণ করা প্রশংসাহ, কিন্তু জ্ঞানের প্রসারতা বৃদ্ধির চেষ্টা ঐশ্বরিক দানের মতো গৌরবজনক।” ইংরেজ রাজত্বের পূর্বে মুসলমান রাজত্বে ইউরোপীয় মিশনারীরা ভাগরথীর তীরে হুগলী জেলার বিভিন্ন স্থানে কুঠি নির্মাণের কারণে এই সকল স্থানে ইংরাজী শিক্ষার প্রসার প্রথমে চোখে পড়ে। জানা যায়, পর্তুগালের জেসুইট সম্প্রদায় ১৫৯৮ সালে হুগলী শহরে বাংলায় সর্বপ্রথম ইংরাজী শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপন করে। এর প্রায় দুই শতক পর শ্রীরামপুরের মিশনারীদের প্রচেষ্টায় এই বাংলায় সাধারণের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করা হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গদেশে পাঠশালার অভাব ছিল না। খ্রিস্টান মিশনারীগণ অবৈতনিক বিদ্যালয় ও পাঠ্যপুস্তক দানে বঙ্গভাষা প্রচারের পথ সুগম করলেও তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল খ্রীস্টধর্ম প্রচার । মিশনারীদের এই কার্যকলাপে সেইসময় হিন্দু সম্প্রদায় ভীত হয়ে পড়ে। সমাজের মাতব্বররা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁদের প্রতিবাদধ্বনি তুলে ধরেন । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ’ মারফত এই প্রতিবাদের আওয়াজকে আরও জোরদার করে তোলেন । এরই জের হিসাবে ১৮৪০ খ্রীস্টাব্দের ১৩ জুন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু কলেজ লাগোয়া পাঠশালার আদর্শে কোলকাতায় ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা ’ স্থাপন করেন । কোলকাতায় এই পাঠশালা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। 
দেবেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন কোলকাতার বাইরে বাংলার মফস্বল অঞ্চলে বাংলা শিক্ষাকে প্রসারিত করতে । তাই ১৮৪৩ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাস পর্যন্ত কলকাতায় পাঠশালাটি চলার পর মহর্ষি হুগলী জেলার বাঁশবেড়িয়ায়  ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা ’ স্থানান্তরিত করেন । কোলকাতার বাইরে নব্যশিক্ষার প্রসারে এই পাঠশালা বাঁশবেড়িয়ায় দিবা ও প্রাতঃবিভাগ দুইই চালু করে পরিপূর্ণ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। কোলকাতায় এই পাঠশালা প্রাতঃকালীন বিভাগ হিসাবে চালু ছিল। স্বনামধন্য সাহিত্যিক অক্ষয়কুমার দত্ত শুরু থেকেই এই পাঠশালায় শিক্ষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন । কিন্তু বাঁশবেড়িয়ায় তিনি একজন স্থানীয় যোগ্য শিক্ষকের হাতে পাঠশালার পরিচালনার দায়িত্ব  দেন। তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা ছয়টি শ্রেনীতে বিভক্ত ছিল । এখানে ছেলেদের ইংরাজী শিক্ষা দেওয়া হলেও সব বিষয়ে বাংলা মাধ্যমেই পড়ান হত । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অক্ষয়কুমার দত্ত নিজেরাই ছাত্রদের পড়ানোর জন্য পাঠ্যপুস্তক লিখতেন । অক্ষয়কুমার পদার্থবিদ্যা , অঙ্ক ও ভূগোল এই সমস্ত পুস্তক বাংলাতেই রচনা করেন । এই পাঠশালায় বাংলার মাধ্যমে শিক্ষাদান প্রসঙ্গে ১৮৪৬ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় লেখা হয় ----
“এই পাঠশালাতে পদার্থবিদ্যা , এবং ভূগোলের উপদেশ বঙ্গ ভাষাতে প্রদান করিবার তাৎপর্য্য এই যে বঙ্গ ভাষা স্বদেশীয় ভাষা , অতএব তাহাতে উক্ত শাস্ত্রে সকল প্রচলিত হইলে ক্রমশঃ তাহার জ্ঞান সাধারন লোকের মধ্যে বিস্তারিত হইতে পারিবেক , দ্বিতীয়তঃ ছাত্ররা অতি অল্প বয়স্ক , অদ্যপি ইংলণ্ডীয় ভাষাতে সুশিক্ষিত হয় নাই যাহাতে উক্ত শাস্ত্র সকল উক্ত ভাষাতে অধ্যয়ন করিতে সমর্থ হয় । যখন তাহারা সুশিক্ষিত হইবে তখন বঙ্গ ভাষাতে উক্ত শাস্ত্র সকলের প্রধান গ্রন্থ অপ্রাপ্ত হইলে ইংলণ্ডীয় ভাষাতে অধ্যাপণা করা যাইতে পারিবেক।” 
তত্ত্ববোধিনী পাঠশালায় সকল বিষয় পড়ানো হলেও এখানে ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল । হিন্দুধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রের সাথে ছাত্রদের পরিচিত করানই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য । বেদ ও উচ্চাঙ্গের হিন্দু ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থগুলি পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল । কোলকাতার পাঠশালার সাথে বাঁশবেড়িয়ার পাঠশালার চরিত্রগত বৈশিষ্ঠগুলো একই ভাবে বজায় রাখা হয়েছিল। সাধারন মানুষের শিক্ষা সম্পর্কে অনাগ্রহ ও সরকারী ঔদাসীন্যের জন্য এইসমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেই সময় স্থাপিত হয়েছিল । সেইকারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোলকাতায় এবং মফস্বলে অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ বাংলার শিক্ষা প্রসারের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় । ১৮৪৫-৪৬ সালের এডুকেশন রিপোর্টেও তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। রিপোর্টে উল্লেখ আছেঃ- Native education in the District – There is an English School at Bansberia, an ancient seat of Hindoo learning , supported by Baboos Debendranath Taagore and Ramaprasad Ray the son of distinguished fathers . It is established for the diffusion of Vedantic principles but is conducted by an ex-student of the [ Hooghly] College, who is himself not of that  persuasion.
তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার  উদ্দেশ্য বৃহৎ হলেও সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সেই সময় জন্মায়নি । বাঁশবেড়িয়ায় পাঁচ বৎসর চলার ১৮৪৮ সালে পাঠশালাটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় । আর্থিক দুরবস্থাও এর প্রধান কারণ ছিল । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ‘ কার টেগোর কোম্পানী’ এবং ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ’ দুটোই তখন পতনের মুখে । দেবেন্দ্রনাথ ও সেই কারণে অর্থাভাবে পড়েন । তাঁর পক্ষেও এই পাঠশালায় অর্থ জোগানের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় । ১৮৪৮ সালের মার্চ মাসে তাই ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা ’-র অকালমৃত্যু  ঘটে । পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন – “দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা কয়েক বৎসর পরে কলিকাতা হইতে বাঁশবেড়িয়া গ্রামে উঠিয়া যায় । পরে ১৮৪৬ সালে ইংলণ্ডে তাঁহার পিতার মৃত্যু হলে বিলোপপ্রাপ্ত হয়।” এরপরে আলেকজাণ্ডার ডাফ এই স্থানে একটি উচ্চবিদ্যালয় স্থাপন করেন।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours