সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

'অফ দি রেকর্ড'। এই কথাটা গলার কাঁটার মতো আমার বিবেককে দংশন করে আজও। আসলে আমার ৩৮ বছরের সাংবাদিক জীবনের অন্যতম বড় পরাজয় এই তিনটে ইংরেজি অক্ষর। 

কর্মসূত্রে তখন আমি আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। প্রায় এক যুগ আগের কথা। ডিপিএল ভবনে তদানীন্তন রাজ্যের বিদ্যুৎ মন্ত্রী মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেস মিট। ব্যক্তিগত সখ্যতার কারণে উনি নিজেই ফোন করে আমাকে আসার অনুরোধ করেছিলেন।

পরের দিন সবার সংবাদ প্রকাশিত হলো। আমার লেখা খবরও। যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে। হঠাৎ বিকেলে চিফ রিপোর্টারের ফোন। একটা ইংরেজি দৈনিকের দৃষ্টান্ত টেনে বললেন, এটা যে এখানে ছাপা হল তা আমাদের কাগজে নেই কেন? তোমার মতো রিপোর্টারের কাছে আমি এই লাইনটা মিস হবে ভাবিনি। তুমি এই লাইন নিয়ে ফারদার কপি করো।

আমি বসকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, মন্ত্রী ওটা মন্তব্য করেন ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও অনুরোধ ছিল, এটা প্রকাশের জন্য নয়। পুরোটাই অফ দি রেকর্ড। অগ্নিশর্মা বস কিছুই শুনতে নারাজ। তাঁর একটাই সাফ কথা, পেশাদারীত্বের দুনিয়ায় অফ দি রেকর্ডের স্হান নেই। খবর তোমায় করতেই হবে।
কোথাও মানতে পারছিলাম না বসের যুক্তি। অগত্যা নিউজ এডিটরের স্মরণাপন্ন। সব শুনে শুধু হাসলেন। তারপর বললেন বসের কথা মানতে হয়। উনারও যে কোথাও জবাবদিহি করার দায়িত্ব রয়েছে। কি আর করা? নিউজটা করলাম। প্রত্যাশা মতো মৃণালবাবুর ফোন পরদিন সকালে। শুধু বললেন, আপনিও পত্রিকার বাজারি সাংবাদিক হয়ে গেলেন। ভেবেছিলাম অন্তত আপনি আমার বিশ্বাসটা রাখবেন।

মৃণালবাবু বহু বছর হলো আপনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বিশ্বাস করুন, আমি এটা মেনে নিতে কোনওদিন পারিনি। আসলে একটা সংশয় আমার মধ্যেও বাসা বাঁধে। কোনটা ঠিক? অফ দি রেকর্ডের গোপনীয়তা ফাঁস করে দেওয়া পেশাদারীত্বের ইঁদুর দৌড়ে। নাকি কথার মর্যাদা রেখে পুরোটাই নিজের অন্তরে আত্মস্থ করা। এই দ্বন্দ্বের শরিক আমি বহুকালের।

ঠিক বারো বছর পর। কালকের রাত। শুয়ে আছি। সেদিন সাংবাদিক হলেও কালের খেয়ালে আজ আমি দ্য অফনিউজ'এর এডিটর। হঠাৎ আমার বিবেক বলে উঠলো, অফ দি রেকর্ড মানে গোপনীয়তার প্রকৃতই রক্ষাকবচ। যা প্রকাশের নয়। আসলে পেশার উর্ধে আরও একটা জিনিস আছে। নৈতিকতা। সেটাই বিসর্জন দিলে একজন সাংবাদিকদের গ্রহণযোগ্যতাকেই হত্যা করা হয়। তাই মৃণালবাবু ফের বলি, দ্বিতীয় দিন আমার নিউজ করাটা ঠিক হয়নি। আপনি যে লোকেই থাকুন, আমাকে ক্ষমা করবেন প্লিজ। আসলে সেদিন আমার কলমও অফ দি রেকর্ডের রক্তে সত্যি লাল হয়ে গিয়েছিল। তবে এটা আজকের ঘটনা হলে আমি নিশ্চিত করে আপনার ভরসাটা রাখতামই। বিলিভ মি। কিন্তু সুযোগটা পেলাম কৈ?
আসলে সময় মানুষকে পাল্টে দেয়। ভাবনাকে পাল্টে দেয়। জীবনকে পাল্টে দেয়। একজন সাংবাদিককেও পাল্টে দেয় অবশ্যই... 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours